১. দুই শ্রেণীর সংযোগ, অব্যয়
এইটা ২০১৫ সালের ঘটনা। ২০১৫ এর একেবারে লাস্টের দিকে। ডিসেম্বরের ১৭-১৮ তারিখ ছিল মনে হয়। একটা কাজে রাইসু ভাই’র সাথে আমার কারওয়ান বাজারে দেখা হইল। দুপুরে, ২ টা বাজে নাই তখনো। সোনারগাঁও এর উলটা দিকে। রাইসু ভাই জানাইলেন ওনার এক বন্ধু আসছে বিদেশ থেকে, ওনার সাথে দেখা করতে চাইছে, এখান থেকে উনি তার সাথে দেখা করতে যাবেন। আমারে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি যাবেন কোথায় এখন, কাজ আছে এরপরে?
আমি বললাম, সাড়ে পাচটা-ছয়টা পর্যন্ত আমি ফ্রি।
উনি বললেন, তাইলে চলেন আমার সাথে।
আমি বললাম, ওকে।
রাইসু ভাই একটা রিকশা ঠিক করলেন তেজগাঁও রেলগেট নাকি তেজগাঁও বাজারের উদ্দেশ্যে, আমার এক্স্যাক্ট মনে নাই। রিক্সায় ওঠার পরে আমাকে জানাইলেন যে তার এই বন্ধুর সাথে বেশ অনেক বছর দেখা নাই। এই বন্ধুটা মেয়ে । বিদেশে থাকে।
আশরাফুল আলম শাওন
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তেজগাঁওয়ে কেন?
উনি বললেন, ওইখানে তার ফিল্মের কাজ করতেছে, শ্যূটিং মনে হয়।
রিক্সায় ওঠার আগে আমরা বারিস্তার স্যান্ডউইচ বা র্যাপ জাতীয় কিছু খাইছিলাম। রিক্সায় উঠে রাইসু ভাই বললেন, বাইরের খাবারের এই এক সমস্যা, এখন ভাল লাগতেছে না। ওরা টেস্ট বাড়ানোর জন্য কী জানি একটা বেশি দেয়। এই জন্যেই বাইরের খাবার খাইতে চাই-ই না।
আমি বললাম, এই কারণেই আমি বাইরে সাধারণত কিছুই খাই না। সেদিন কবে জানি আফতাবের না কার পাল্লায় পইড়া বনানীতে বিরিয়ানি খাইতে হইল। মোটামুটি পশ জায়গা, ডিশটা দেখতে খুব সুন্দর, শুরুর দিকে খাইতেও টেস্টি। কিন্তু বাসায় যাওয়ার পরে মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেল। আমি খেয়াল করছি, যেদিনই আমাকে এরকম বাইরের বিরিয়ানি খাইতে হইছে, সেদিনই পরে আমার মাথা ব্যথা শুরু হইছে। অদ্ভুত না?
রাইসু ভাই বললেন, কেন? এইটা কি বিরিয়ানির তেলের কারণে?
আমি বললাম, কী জানি? হইতে পারে। গত এক বছরে দুই বা তিনবার এরকম হইছে।
রাইসু ভাই বললেন, বাইরে খাইলে, পরে টায়ার্ড লাগে।
আমি বললাম, হু, মুড অফ হইয়া যায়। ইভেন কোনো দাওয়াতে গেলেও।
বাইরের খাবার থেকে বেন অ্যাফ্লেকের একটা সিনেমা, সেইখান থেকে বিল মাহের এইসব নিয়ে কথা বলতে বলতে রিকশা বস্তির মত একটা এলাকায় ঢুকল। আমি যেহেতু আগে কোনোদিন বস্তির ভিতরে যাই নাই, আনকমফোর্টেবল লাগতেছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী নিয়ে ফিল্ম, গরীব মানুষ?
রাইসু ভাই বললেন, ডকুমেন্টারি মনে হয়।
আমি ভাবতেছিলাম এইটা মনে হয় বস্তি না, বস্তি মনে হয় আরো নোংরা আর স্যাতসেতে হয়। জায়গাটা পরিষ্কার আছে।
এরপরে উনি ফোনে কার সাথে যোগাযোগ করলেন। আমরা জায়গামত পৌঁছাইয়া গেলাম। ৩০-৩২ বছর বয়সী এক লোক এসে আমাদের রিসিভ করল। রাইসু ভাই ওনাকে চিনে।
সেই লোক আমাদেরকে কয়েকটা বাড়ির পিছন দিয়ে আরেকটা বাড়িতে নিয়ে আসল। ছোট একটা গেট। গেটের ভিতরে ঢুকলে ছোট একটা করিডোরের মত, উপরে আকাশ। ডান পাশে ঘর। বাম পাশে অন্য বাড়ির দেয়াল। এই বাড়ির ঘরের দেয়াল আর অন্য বাড়ির দেয়ালের মাঝখানের জায়গাটাই আসলে করিডোরের মত মনে হয়। অন্য বাড়ির দেয়াল হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে করিডোর শেষপর্যন্ত আর করিডোর থাকে নি, মনে হয় ঘরের দরজার সামনে উঠানের মত সামান্য জায়গা।
আমাদেরকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে সেই ৩০-৩২ বছর বয়সী লোক রাইসু ভাই’র বন্ধুকে ডাক দিলেন, আপা, সী হু হ্যাজ কাম।
সেই বন্ধুটি আসলেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে, তিনি তার মত করে, তার বন্ধু অর্থাৎ রাইসু ভাইকে সম্ভাষণ জানালেন। আমি পরিচিত হলাম। উঠানের মত জায়গায় শ্যূটিং এর আরো লোকজন। একজন বিদেশী সিনেমাটোগ্রাফার।
আমাদেরকে ঘরে নিয়ে যাওয়া হইল। খুবই ছোট একটা ঘর। ঘরে রিমার্কেবল কিছুই নাই, তবে অনেক জিনিসপত্র। এবং এই একটা ঘরই আসলে এই একটা বাড়ি। অনেক বড় একটা খাট বা চৌকি, পাশে একটা শোকেস। চৌকির পায়ার নিচেও ইট দেওয়া, শোকেসের পায়ার নিচেও ইট দেওয়া। ঘরের চাল কীসের, দেওয়াল কিসের এইগুলা আমার মনে নাই। তখন বোধহয় ধরতেই পারি নাই এইগুলা কীসের। তবে ফ্লোর কনক্রিটের, এইটা মনে আছে।
রাইসু ভাই চৌকিতে বসলেন, আমারে একটা চেয়ার দেওয়া হইল। অপরিচিত পরিবেশ এবং সঙ্গের লোকের পরিচিত কিন্তু আমার অপরিচিত মানুষের সামনে আমি যে রকম হয়ে যাই, এক্সট্রিমলি স্টিফ, অলরেডি অনেক আগে থেকেই, মানে রিকশা থেকে নামার পরেই সেই অবস্থায় চলে গেছি। তখন আমার এক্সপ্রেশন, জেশ্চার খুবই আনফ্রেন্ডলি।
রাইসু ভাই তার সেই বন্ধুটির সাথে খোঁজ-খবর, পুরাতন দিনের কথা, আরো কয়েকজনের কথা এইসব আলাপ করলেন। যা জানা গেল, সেই বন্ধুটি ১৯৭১ এর বীরাঙ্গনাদের নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করছেন। এখন একজন বীরাঙ্গনাকে নিয়ে কাজ চলছে। এইটা তারই ঘর।
যার ঘর তিনি আসলেন একটু পরে। বৃদ্ধা মহিলা। কিন্তু খুব দ্রুত চলাচল করেন। সবসময় কথা বলতেছেন। তার সাথে তার মেয়েও আসল। সেই বৃদ্ধা মহিলা রাইসু ভাই এর প্রতি রিমার্কেবল মমতা দেখাইলেন। বললেন, এইটা আমার বাবা। মাথায় হাত বুলাইলেন। বললেন, এই বাবারে আমি কই জানি দেখছি। একটু পরে আবার বললেন, বাবার অন্তরডা খুব ভাল। এই কথা শুইনা রাইসু ভাই সরলভাবে হাসতেছেন। কিছুটা যেন অপ্রস্তুত। রাইসু ভাই আমার দিকে তাকাইয়াও হাসলেন।
সেই বৃদ্ধা সিগারেট ধরাইলেন। এলাকার কাকে ধমক দিছেন, কে তাকে সম্মান করে, এইসব কথা বলতেছিলেন। উনার মেয়ে আবার তার কথা স্পষ্ট করার জন্য মাঝে মাঝে ব্যাখ্যা করতেছিলেন।
রাইসু ভাই এর সেই বন্ধুটি সেই বৃদ্ধাকে খালা ডাকতেছিলেন। ইতোমধ্যে কয়েকবার জড়িয়ে ধরছেন। তার কথায়, এক্সপ্রেশনে স্পষ্ট হয় যে এই বৃদ্ধার পরিবারের প্রতি তিনি মমতা বোধ করেন।
আমাদেরকে জানানো হইল যে, আজকে তাদের শ্যূটিং শেষ হয়ে যাচ্ছে এই উপলক্ষ্যে সবাই আজ কাচ্চি বিরিয়ানি খাবে। আনতে লোক গেছে। আমাদেরকেও খাইতে হবে। এই বইলা রাইসু ভাই এর সেই বন্ধুটি ঘরের বাইরে চলে গেলেন।
রাইসু ভাই আমার দিকে তাকাইয়া, এই জোক যেন আগেই শুইনা ফেলছেন সেই রকম একটা হাসি দিয়া বললেন, আল্লাহ, বস আমরা না রিকশায় আসতে আসতে বিরিয়ানির বদনামই করলাম!
আমি বললাম, আয়রনি অব নেচার।
সেই বন্ধুটি আবার ঘরে আসলেন। বৃদ্ধার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার মা’টা কই? অর্থাৎ বৃদ্ধার মেয়ের মেয়ে সম্পর্কে, মানে বৃদ্ধার নাতনি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন।
১০-১২ বছরের সেই মেয়েটিকে ডেকে আনা হইল। রাইসু ভাই’র সেই বন্ধুটি তাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার মা’টাকে কতক্ষণ ধরে খুঁজতেছি! কই গেছিলা মা!
বাচ্চা মেয়েটা একটু লজ্জা পাইতেছিল।
এরপরে রাইসু ভাই’র দিকে তাকাইয়া তার সেই বন্ধুটি বললেন, জানো, ওরে নাকি স্কুলের ওর এক স্যার গান গাইতে মানা করছে, বলছে যে তোমার গান গাওয়ার দরকার নাই।
রাইসু ভাই কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞেস করলেন, কেন, মানা করছে কেন?
সেই বন্ধুটি, ওই বাচ্চা মেয়েটার মা, অর্থাৎ বৃদ্ধার মেয়ের দিকে তাকায়া জিজ্ঞেস করলেন, কেন মানা করছে?
আমি ততক্ষণে মনে মনে আশংকা কইরা ফেলছি যে, সম্ভবত গলা খারাপ, স্যারে মনে হয় কনজার্ভেটিভ না।
ঘটনা সেই রকমই। মেয়ের মা বলল, স্যারে বলছে যে তোমার গলা ছেলে মানুষের মত, তাই তোমার গান গাইতে হবে না।
রাইসু ভাই এর সেই বন্ধুটি বলল, শয়তান স্যার। বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকাইয়া বলল, তুমি কিন্তু গান থামাবা না মা, তুমি গান করবা বুঝছো।
ততক্ষণে কাচ্চি বিরিয়ানি চইলা আসছে। বিরিয়ানির প্যাকেট দেইখাই বুঝলাম, এতক্ষণ আশঙ্কা ছিল শুধু বিরিয়ানি নিয়া, কিন্তু সংকট আরো গভীর। বিরিয়ানির মান নিয়াও আশঙ্কা করা উচিৎ। আমার চেহারা দেইখাই সম্ভবত রাইসু ভাই সাহস দিলেন, কিন্তু তিনিও তো সমান সঙ্কটে। আমারে আস্তে কইরা বললেন, কী আর করা, ফর্মালিটি রক্ষার জন্য যতটুকু পারলেন আর কি, দেখানোর জন্য। নাইলে খারাপ দেখাবে। আমি বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রোবলেম নাই।
রাইসু ভাই’র সেই বন্ধুটি আবার ঘরে ঢুকলেন। বৃদ্ধাকে বললেন, খালা আপনি খেয়ে নেন তাড়াতাড়ি, আপনার ক্ষুধা লাগছে তো! অনেক বেলা হইছে।
তারপরে বৃদ্ধার মেয়েকে বললেন, খালাকে আগে দাও। খালা কাচ্চি বিরিয়ানি খাইতে চাইছে, সেই জন্যই তো আজকে বিরিয়ানি আনা হইল।
খাওয়া দাওয়া শেষ। গল্প-কথাবার্তাও মোটামুটি শেষ। একটু পরেই সন্ধ্যা পড়বে। ঘরের ভিতরে সেই বৃদ্ধা। আর কেউ নাই। কিছুক্ষণ পরেই আমি আর রাইসু ভাই চলে আসব এখান থেকে। ঘরের সামনের সেই করিডোরে, অন্য বাড়ির পিছনের সেই দেয়ালে হেলান দিয়ে রাইসু ভাই দাঁড়ায় আছেন। তার পাশে তার সেই বন্ধুটি, ডকুমেন্টারি নির্মাতা দাঁড়ায় আছেন। আমি তাদের সামনে দরজায় দাঁড়ায় আছি। আমার জ্যাকেটের পকেটে হাত, আমি প্রথম দিকের মতই চুপচাপ, মুখ চোখ গম্ভীর করে দেখতেছি সবকিছু। রাইসু ভাই দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো, অল্প অল্প হাসতেছেন। হঠাৎ, একটু উপরের দিকে মাথা তুলে, খুবই শান্ত অথচ ডীপ কসমিক টোনে, যেন প্রকৃতিকে শোনাইতেছেন, এমনভাবে বইলা উঠলেন—দুই শ্রেণীর সংযোগ, অব্যয়।
এই কথা শুইনা, আমি বুঝতে পারার আগেই দেখি আমি হাসতে হাসতে বাম দিকে কাত হয়ে গেছি।
রাইসু ভাই’র সেই বন্ধুটির মুখ দেখি কালো হইয়া গেছে। উনি সামান্য পরেই নিজেকে সামলে নিছেন। ফান বুঝতে পারছেন, এমনভাবে একটু হাসলেন, রাইসু ভাই’র হাতে চড় দেওয়ার ভঙ্গি করলেন, আস্তে বললেন, যাহ! তবে মুখে স্পষ্ট কালো ছায়া।
আর আমি তখনো হাসতেছি। আর চিন্তা করতেছি—কোনো পলিটিক্যাল স্পেস তৈরি হওয়ার সুযোগ না রেখে, ক্লাসের হায়ারার্কিরে অদৃশ্য কইরা রাইখা, সোসাইটিতে, ইকোনোমিক্যালি দুই প্রান্তের দুই শ্রেণীর এইরকম অ্যারেঞ্জড, সাজানো-মেশামেশি বা সংযোগের মাধ্যমে যা তৈরি হয়, সেইটা যে অপব্যয়—এই জিনিসটা উনি এতক্ষণ ধরে কী সুন্দর পর্যবেক্ষণ করলেন। হাসতে হাসতে দেখতে দেখতে। আর প্রকাশ করলেন কী রকম এক্সপ্লোসিভলি!
এরপর বের হয়ে, মেইন রোডে এসে দুইজন দুইদিকে চলে যাই। তার একদিন পরে আমি ঢাকার বাইরে চলে যাই। তারও পরের দিন রাতে ফেসবুক খুলছি, দেখি রাইসু ভাই পোস্ট দিয়ে জানাইছেন যে, ডকুমেন্টারির কাজ শেষ হয়ে যাওয়া উপলক্ষ্যে রাইসু ভাই’র সেই বন্ধুটি একটা পার্টি দিছিল। পার্টি মানে পার্টি। রাইসু ভাইরেও নাকি সেই জায়গায় দাওয়াত দেওয়া হইছিল। উনি সেইখানে গেছে। এবং ওইখানে কোনোকিছু না ঘটা সত্ত্বেও রাইসু ভাইকে নাকি সেই ভদ্র মহিলা সেখান থেকে বের করে দিছে।
২. কাশি হইছে
এইটা কয়েক বছর আগের ঘটনা। বইমেলায়। সেই বারের পরে আমি আর বই মেলায় যাই নাই। এমনিতেই যাই নাই। যাই হোক, বই মেলায় আমি আর মুনতাকীম ভাই বসে ছিলাম। মুনতাকীম ভাই মানে মুনতাকীম চৌধুরী, রাইসু ভাই’র ছোটবেলার বন্ধু। তারা একসাথে স্কুলে পড়াশোনা করছেন। যাই হোক, আমি আর মুনতাকীম ভাই বসে ছিলাম, সম্ভবত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোণার দিকে। রাইসু ভাই’র আসার কথা, আইসা আমাদের সাথে জয়েন করবেন।
আমরা একটা বেঞ্চে বসে ছিলাম। ওইদিকে ভিড় নাই, বইয়ের দোকান-টোকানও একটু দূরে। একটু পরে দেখলাম রাইসু ভাই আসতেছে। উনি হাসতেছেন। গায়ে সোয়েটার, গলায় মাফলার পেঁচানো। উনি কাছাকাছি আসলে মুনতাকীম ভাই তারে জিজ্ঞাসা করলেন, কীরে, দেশের কী অবস্থা? যেন সামান্য সমস্যায়ই পড়ছেন, এমন টোনে, রাইসু ভাই খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন—ভালো না, কাশি হইছে।
এইটা শুইনা আমি আর মুনতাকীম ভাই দুইজনেই হাসতেছিলাম।
৩. রইদে দেওয়া প্লাস্টিক
ব্রাত্য রাইসু’র এইরকম উইটি রিপ্লাই বা রিফ্লেকশন দেওয়ার ঘটনা যে কতশত!
রাইসু ভাই’র বাসায়। দুপুরে খাওয়ার সময় হইছে। আমরা খাইতে বসতেছি। আমরা বলতে আমি আর রাইসু ভাই। আর কেউ নাই।
আমি অলরেডি বইসা পড়ছি। উনি বসার আগে দরজার পর্দা সরাইয়া দিচ্ছিলেন। বাম পাশের দেয়ালের পুরোটাই কাচের স্লাইডিং ডোর। অনেক উপরের বাসা। পর্দা সরাইয়া দেওয়ার কারণে সুন্দর রোদ এসে ঘরে ঢুকছে। বিভিন্ন জিনিস নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা আমাদের পরিচিত দূরের এক ভদ্রলোকের বিষয়ে আলাপ করতেছিলাম। রাইসু ভাই পর্দা সরাইয়া দিয়া আমার সামনে আইসা দাঁড়াইছেন। কথার এক পর্যায়ে আমার কথা ছিল, …আর ওনার বউটারে দেখছেন, এমন ভাব করে, অথচ দেখলে মনে হয় প্লাস্টিক।
রাইসু ভাই আমার সামনে বসতে বসতে উত্তর দিলেন, বলছে আপনেরে! খালি প্লাস্টিক! প্লাস্টিক রইদে দিলে যেইটা হয়! এই কথা বইলা একটা অমায়িক হাসি দিলেন।
৪. বীন উইদ হোয়াইট রাইস
আমার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বন্ধু জাওয়াদ আহমেদ অর্ক একদিন রাইসু ভাই’র বাসায় গেছে। জাওয়াদ আহমেদ অর্ক দাবি করে সে অনেক বড়লোক ফ্যামিলির সন্তান। যদিও অর্করে দেখলে বা তার লাইফস্টাইল দেখলে কাউরে পয়সা দিয়াও এই কথা বিশ্বাস করানো যাবে না। তবে তার সাথে একটু মিশলেই বোঝা যায় সে টাকা, শিক্ষা ও সম্মানওয়ালা ফ্যামিলির সন্তান, এবং সে খুবই আরবান। আরেকটু স্পষ্ট করি, ঢাকা শহরের উচ্চ মধ্যবিত্ত বা অ্যাফ্লুয়েন্ট মিডল ক্লাস বলতে যা বোঝায়, অর্করা তাই। লালমাটিয়ায় নিজেদের লাক্সারিয়াস ফ্ল্যাট, গাড়ি, বারিধারা ও উত্তরায় নিজেদের জায়গা… ইত্যাদি। যদিও সে সারা মাসে এক হাজার টাকাও খরচ করতে পারত না সেইটা আলাদা আলাপ। তাইলে, ডিফারেন্ট ক্লাসেস অ্যান্ড দেয়ার সাইকোলজি টু দেয়ার চিলড্রেন—এইটা নিয়ে আলাপ করতে হবে। উই শুড লীভ দ্যাট নাউ।
অর্ক রাইসু ভাই এর সাথে দেখা কইরা আলাপ করতে চাইতেছিল, পরিচিত হইতে চাইতেছিল। আমি বলছিলাম, আমি এরমধ্যে কোনো একদিন গেলে তরে ফোন দিয়া ডাকব।
একদিন বেলা এগারোটার দিকে অর্করে ডাকা হইল রাইসু ভাই’র বাসায়। অর্করে দিয়া ইলাস্ট্রেশনের কাজ এবং লোগো ডিজাইনের ব্যাপারে তারে ডাকা হইল।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা হইল। অর্ক রাইসু ভাইয়ের সাথে আলাপ করল। কাজের আলাপ না, এমনি কথাবার্তা। কিছুক্ষণ পরে অর্ক আমারে আলাদাভাবে জানাইল যে বাসাটা তার খুবই পছন্দ হইছে। এই কথা পরেও সে আমারে অনেকবার বলছে। এরপরে সে আমারে আস্তে আস্তে বলল, ওপেন আছে, স্টিফ না।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী, বাসা?
সে বলল যে, না, রাইসু ভাই, মানুষ হিসাবে।
এমন টোনে বলল যে মনে হয় রাইসু ভাইরে এভালুয়েট করাটাই ছিল তার আজকের দিনের একমাত্র উদ্দেশ্য।
যাই হোক, এর বেশ কয়েকদিন আগে একদিন বাইরে কোনো এক সুপারশপে কিছু বাজার করার সময় আমি রাইসু ভাইরে বীন দেখায় দিলে উনি বীন, মানে রাজমা কিনে আনছিলেন। সেইদিন দুপুর একটার সময় উনার হঠাৎ মনে পড়ছে সেই কথা, আমারে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা বস, সেদিন যে বীন আনলাম, আমরা বীন খাব না?
আমি বললাম, হ্যাঁ, খাওয়া তো যায়ই। আপনি এখনো খান নাই?
উনি বললেন, না, কিন্তু ওইগুলা রানবে কে? কেউ তো ওইগুলা রান্না করতে পারে না। আপনি বীন রানতে পারেন?
আমি বীন রান্না করতে পারতাম। কিন্তু অস্বীকার করলাম। বললাম যে, পারি না, আমি যেগুলি বাসায় নিয়ে গেছি, ওইগুলি তো ওইভাবেই আছে। কারণ, আমি যদি বলতাম যে আমি পারি, কিন্তু করতে চাই না। উনি কোনোভাবে আমারে কনভিন্সড কইরা ফেলতেন বীন রান্না করার জন্য। তখন রাইসু ভাই অর্করে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি পারেন?
অর্ক সুন্দর একটা হাসি দিয়া ডানে বামে মাথা নাড়ল। মানে, না।
উনি বললেন, ওহ! নেট আছে না! গুগল আছে কী জন্যে? আমার দিকে তাকাইয়া বললেন, আপনার মাথায়ও এইটা আসে নাই। সার্চ দিলেই তো পাওয়া যাবে।
রাইসু ভাই সার্চ দিয়া বীন রান্নার সিস্টেম বের কইরা ফেললেন। এরপরে বাসায় থাকা একজনরে ডাক দিয়া জিনিসটা বুঝায় দিলেন।
বীন রান্না শেষ। দুপুর দুইটা বাজে তখন। দুপুরে খাওয়ার সময় হইছে, আমরা খাইতে বসছি। রাইসু ভাই এর আর বীনের কথা মনে নাই। টেবিলে সব খাবার আসছে। বীন রান্নাঘরে।
আমি রাইসু বললাম, বীন বিকালে রান্না করাইলেই তো পারতেন।
উনি চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, এই, বীন কই? বীন আমরা কখন কীভাবে খাব?
আমি বললাম, এখন ভাত খাওয়ার টাইম, বীন দিয়া কী করবেন? বীন তো এমনি খাইতে হবে।
অর্ক আস্তে আস্তে বলল, ভাত খাওয়ার সময়ে বীন তো খাওয়া যাবে না।
রাইসু ভাই এর চোখ আনন্দিত হয়ে উঠল, অর্ক’র দিকে প্রাণখোলা একটা হাসি দিয়া বললেন, কেন, আমরা ভাতের সাথেই খাব। যেন র্যাম খুইলা রাইখা কম্পিউটার অন করতে বলা হইছে, এমন একটা হাসি দিয়া অর্ক বলল, এইটা কীভাবে সম্ভব?
রাইসু ভাই পালটা হাসি দিয়া বলল, সম্ভব। খাইতে ভালো লাগবে, দেখেন। অর্ক আর কিছু বলল না।
ততক্ষণে ভাত খাওয়া অলরেডি শুরু হইয়া গেছে। আমি লালশাক দিয়া কিছুদূর খাইয়াও ফেলছি। রাইসু ভাই কাউরে রান্নাঘর থেকে বীন আনতে বললেন। সে বীন নিয়া আসল। রাইসু ভাই নিজে সেই বীন ভাতের সাথে নিলেন। অর্করে দেওয়া হইল। সবাই নিল। আমি নিলাম। আমি যেহেতু এই উইয়ার্ডনেসের সাথে পরিচিত এবং আমার একটা ব্যাখ্যা আছে যে রাইসু ভাই কেন এমন করলেন, এই ব্যাপারটা আমার কাছে সারপ্রাইজিং কিছু ছিল না।
আরবান মিডল ক্লাস বা আপার মিডল ক্লাসের নিজেদের শ্রেণী অবস্থান ও লাইফস্টাইল নিয়ে যে আর্টিফিশিয়াল প্রাইড এবং শো-অফ সেই ব্যাপারটারে ডিসটর্ট করার জন্যই রাইসু ভাই এই ধরনের কাজ করেন।
পরে যখন অর্ক আমার সাথে নিচে নামল সন্ধ্যায়, ততক্ষণে বীন ব্যাপারটা আর আমার মাথার মধ্যে নাই। নিচে নাইমা অর্ক প্রথম কথা বলল, ভাতের লগে বীন খাওয়ায় দিল, এইটা সম্ভব!
পরে অর্ক এই জিনিসটা অনেক বার রিপিট করছে। হাসতে হাসতে বলত, হায় হায়! ভাইরে ভাই, সাদা ভাতের সাথে বীন খাইছিলাম। কী মানুষরে! এই এক ডায়লগ কতবার যে দিছে! আমি তখন রাইসু ভাইরে সাপোর্ট কইরা বলতাম, উনি ইচ্ছা কইরাই এ রকম কাস্টোমাইজ করছে। অর্ক বলত, রাখ তর কাস্টোমাইজ, আমারে বুঝাও, না!
এরপরে একবার একদিন অর্ক তাচ্ছিল্যের এক্সপ্রেশন দিয়া বলছিল, রাস্তার পুডিং! রাইসু ভাই সেদিন তখনি অর্করে নিয়া রাস্তার পুডিং খাইছিলেন। অর্ক সেই পুডিং খাইতে খাইতে বলছিল, এই পুডিং! আর আমাদের বাসায় যে পুডিং রান্না করে!
৫. কফি উইদ ব্রাত্য রাইসু
একদিন আমি আর রাইসু ভাই কফি খাইতে ঢুকছি। বারিস্তায় অথবা কফি ওয়ার্ল্ডে। আমার এক্স্যাক্টলি মনে নাই, তবে দুইটার একটা। দুপুর বেলা। রাইসু ভাই আমারে জিজ্ঞাসা করলেন, কফির সাথে কিছু খাবেন না?
আমি বললাম, না, আমি বের হওয়ার আগে দুপুরে খেয়ে বের হইছি। উনি বললেন, আমিও অবশ্য খাইয়া বের খাইছি। শুধু কফিই অর্ডার করি তাইলে।
আমি আমেরিকানো অর্ডার করলাম, উনি লাটে অথবা মকা অর্ডার করলেন। এরপরে আমার দিকে তাকাইয়া বললেন, একটা স্যান্ডউইচ অর্ডার করি? উনাদের স্যান্ডউইচ ভালো বস।
আমি বললাম, আপনি খাইতে চাইলে করেন। তারপর কাউন্টারে তাকায়া বললেন, ভাইয়া আপনাদের ভালো স্যান্ডউইচ কোনটা আছে? এরপর একটা স্যান্ডউইচ অর্ডার করলেন। দুপুর বেলা। লাঞ্চের সময়। অনেক ভিড় জায়গাটায়। সবাই কথা বলতেছে।
আমরা একটা টেবিলে বসলাম। কথা বলতে বলতে কফি দিয়া গেল। স্যান্ডউইচটা দুই ভাগ কইরা রাইসু ভাই বললেন, অর্ধেক অর্ধেক খাই।
আমি বললাম, পারব না খাইতে।
উনি বললেন, আরে পারবেন। আমার প্লেটে অর্ধেক স্যান্ডউইচ দিলেন।
কফি খাইতে খাইতে কথা বলতেছি। যেন আমারে ভাতের সাথে সালাদ নিতে বলতেছেন, এমন সহজ টোনে ও পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ভিজাইয়া খান, ভালো লাগে।
আমি তখন খেয়াল করলাম যে উনি খুব সুন্দরভাবে ওনার স্যান্ডউইচ মগের কফিতে ভিজাইয়া খাইতেছেন। এত সহজ ও স্বাভাবিকভাবে বললেন যে আমি অলমোস্ট কনভিন্সড। কিন্তু আমার কফি তো আমেরিকানো, কীভাবে ভিজাইয়া খাই! ফলে এইটা নিয়া আমি আর সেকেন্ড থট দিলাম না। তবে আমেরিকানো না হইলে হয়ত চিন্তা করতাম।
আমি বললাম, না, আমারটা তো ব্ল্যাক!
রাইসু ভাই বললেন, ওহ! তাইলে তো পারবেন না।
উনি ওনার মত খাইলেন। আমি আশেপাশে তাকাই নাই। এক দুইবার আশেপাশে চোখ পড়ায় দেখলাম, দুই একজন হয়ত ওনার দিকে তাকাইয়া আছে। আমি ভাবছি এমনি তাকাইয়া আছে, এ রকম চোখ তো পড়েই। তখন আমার কিছুই মনে হয় নাই, কিছুই সন্দেহ হয় নাই। দুইদিন পরে আমি জিনিসটা ধরতে পারলাম। কফিতে স্যান্ডউইচ ভিজাইয়া খাইলে টেস্টি লাগে—এই কারণে রাইসু ভাই কাজটা করেন নাই। ওই যে এর আগের ঘটনায় বললাম, আরবান মিডল ক্লাস বা আপার মিডোল ক্লাস একটা লাইফস্টাইল ফলো কইরা বা কিছু সার্টেইন জিনিস কনজ্যুম করে নিজেদের ক্লাসের ব্যাপারে যে প্রাইড নেয়, সেই জিনিসটারে ডিসটর্ট করার জন্য, সেই প্রাইডরে যে উনি পাত্তা দেন না, দুই নম্বরি মনে করেন—সেই জায়গা থিকা তিনি ইচ্ছা করেই কাজটা করছেন।
৬. বিরিয়ানি অ্যাগেইন
একদিন আমি আর রাইসু ভাই কোথা থেকে যেন আসছি। পান্থপথে আসছি। রাইসু ভাই সেইখান থেকে তার বাসায় চলে যাবেন, আর আমি আমার বাসায় আসার জন্য একটা সিএনজি নিব। রাত ৯টা পার হইছে। ৯টা দশ বা পনের বাজে। রাস্তায় আসতে আসতে উনি বলতেছিলেন, কী খাওয়া যায়? ভালো খাওয়ার জিনিস কী আছে? আমি বললাম, কিছুই তো নাই। কী খাবেন? রাইসু ভাই প্রোবলেম সলভ করতে হবে—এই টোনে বললেন, তাইলে ভালো খাবার কোথায় পাওয়া যায়? এত বড় একটা শহর আর আমরা খাওয়ার উপযুক্ত একটা জিনিস খুইজা পাবো না, এইটা কথা!
তখন আমি সম্ভবত অন্য কিছু ভাবতেছিলাম, বেখেয়ালে বইলা ফেললাম, বিরিয়ানি খাবেন? বলার সাথে সাথে আমি চিন্তা করলাম, এইটা কী করলাম আমি! কিন্তু যা হওয়ার তা তো আমি বইলাই ফেলছি। খেয়ালে বা বেখেয়ালে—দ্যাট ডাজন’ট ম্যাটার।
রাইসু ভাই বললেন, তাইলে চলেন, বিরিয়ানি খাই।
আমি বললাম, এখন কি বিরিয়ানি ভালো লাগবে?
রাইসু ভাই বললেন, ভালোই লাগবে। চিকেন বিরিয়ানি খুঁজি চলেন।
আমি তখন নিজেরে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললাম, সাড়ে নয়টার মত বাজে তো, অনেক জায়গায় রাতের জন্য ফ্রেশ বিরিয়ানি রান্না করে। এই টাইমের দিকেই রান্না করে।
উনি বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম ফ্রেশ। বাসী-টাসী, দুপুরের-টুপুরের গুলা না।
রাস্তায় তো অনেক দোকান, অনেক রেস্টুরেন্ট। যেইটাকে একটু যোগ্য মনে হয় সেইটার দিকে আগায়া যাই। আমি জিজ্ঞাসা করি বিরিয়ানি আছে? চিকেন? আর রাইসু ভাই জিজ্ঞাসা করে, ফ্রেশ? কেবল রান্না করা?
চিকেন পাওয়া যায়, কিন্তু ফ্রেশ পাওয়া যায় না। অধিকাংশ দুপুরের দিকের। আবার ফ্রেশ পাওয়া গেলে সেইটা আবার চিকেন না।
যাই হোক একটা রেস্টুরেন্ট পাওয়া গেল, যেইটায় চিকেন এবং ফ্রেশ। ওয়েটার খুব বিনয়ের সাথে বলল যে কেবলই, দুই মিনিট হইল, চিকেন বিরিয়ানির ডেগচি চুলা থিকা নামানো হইছে। রাতে তাদের অনেক কাস্টোমার, এইজন্য প্রতিদিন তাদের রাত দশটার দিকে নতুন বিরিয়ানি রান্না হয়। রাইসু ভাই বললেন, কই দেখি! সেই ওয়েটার কাছে নিয়া যাইয়া ডেগচির ঢাকনা তুলে দেখাইল।
আমরা অর্ডার করলাম। রাইসু ভাই বললেন, ভালোই মনে হচ্ছে, না? আমার মাথায় তখন ঘড়ি চলতেছে, বাসায় যাব কখন? আমি বললাম, হুম।
আমরা বসছি। ওয়েটার বিরিয়ানি দিয়া গেছে। আমার মাথার ভিতরে বাসায় ফেরার তাড়া। আমি বিরিয়ানিতে হাত দিলাম। ডিমটা মাঝে দুই ভাগ করে কুসুম আলাদা কইরা ফেললাম। এখন জাস্ট মুখে তুলব।
আমার সামনে বসা রাইসু ভাই ধীরস্থির। উনি বিরিয়ানির দিকে তাকাইলেন। হয়ত মনে মনে সন্দেহ করলেন। তারপর জ্বর দেখার মত কইরা আলতো কইরা বিরিয়ানীর কপালে হাত রাখলেন। হ্যাঁ, তাই, বিরিয়ানির জ্বর।
উনি আমারে বললেন, বস বিরিয়ানি তো বাসী। যেইটা দেখাইছে ওইটা তো দেয় নাই আমাদের।
আমার মাথায় চিন্তা আরো জটিল হইতেছে, বিরিয়ানির চিন্তা না, রাত, সিএনজি এবং বাসায় যাওয়ার চিন্তা। আমি বিরিয়ানির ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হওয়ার চেষ্টা কইরা বললাম, কী বলেন?
উনি বললেন, দেখেন, হাত দিয়া দেখেন।
আমি তো হাত আগেই দিছি, ডিম পর্যন্ত ভাইঙ্গা ফেলছি। তবু আমি নতুন করে হাত দিলাম। রাইসু ভাই বললেন, তাই না, দুপুরের জিনিস দিছে না? দেখছেন! ওঠেন বস। অন্য রেস্টুরেন্ট দেখি। আর ওই লোক কই?
আমি সেই ওয়েটাররে দেইখা ইশারা করলাম। সে আসল। রাইসু ভাই তারে বললেন, আপনে তো আমাদের নতুন বিরিয়ানি দেখাইয়া বাসী বিরিয়ানি দিছেন। এই কাজ কেন করলেন?
সেই ওয়েটার বলে, না স্যার, যেইটা দেখাইছি, ওইটাই দিছি।
রাইসু ভাই বললেন, আমরা কি পয়সা দিয়া খাব না? নাকি পয়সা কম দিব? চাইছি এক জিনিস, আপনি দিছেন অন্য জিনিস। আপনি কখনোই সেইটা দেন নাই।
ওয়েটার বলল, না স্যার, ওইটাই দিছি।
রাইসু ভাই বলল, মিথ্যা বলতেছেন। এই জিনিস তো ওভেনে গরম করা।
ওয়েটারের চেহারা এইবার বদলাইয়া গেল। বলল, স্যার, আমি দেখতেছি, দেওয়ার সময় মনে হয় ভুল করছে। স্যরি, আমি এখনি বদলাইয়া দিতেছি।
রাইসু ভাই বললেন, না না, আমরা এইখানে খাবই না তো আর। আপনি তো বাটপারি করছেন।
আমরা বের হইয়া আসলাম সেইখান থিকা।
আরেক রেস্টুরেন্টে যাইয়া জিজ্ঞাসা করলাম, সেখানে আমাদেরকে জানানো হইল সন্ধ্যার, না না, বিকালের দিকে রান্না করা হইছে। রাইসু ভাই আমার দিকে তাকাইলেন। তখন আমাদের আর এনার্জি এবং মুড কোনোটাই আর নাই। জাস্ট বিরিয়ানিকে দেওয়া কথা রক্ষা করতে হইবে। আমি বললাম, দেরি হইয়া গেছে, বাসায় ফিরতে হবে।
রাইসু ভাই বললেন, চলেন, ওদের যা আছে ওইটাই নেই। সেই বিস্বাদ বিরিয়ানি খাইতে খাইতে উনি আমারে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদেরকে ওইখানে ফ্রেশ জিনিস দিল না কেন?
আমি বললাম, ব্যবসা করতে চাইছে।
উনি বললেন, না না, ইচ্ছা কইরাই দুই নম্বরি করছে, ভাবছে আমরা ধরতে পারব না।
এরকম আরেকদিন অন্য একটা জিনিস খাওয়ার প্রসঙ্গে আরেকটা জায়গা থেকে বের আমরা বের হয়ে আসছিলাম। সেদিন অবশ্য তিনজন ছিলাম। আমি, ব্রাত্য রাইসু আর নাসিফ আমিন।
৭. গ্যাংস্টার’জ প্যারাডাইজ
এইটা মনে হয় ২০১৩ সালের ঘটনা। কোনো এক শুক্রবার। আমি কম্পিউটার গেমস নিয়া কথা তুলছি। বললাম, সাইটে (shamprotik.com) তো গেমস নিয়া লেখা থাকা দরকার।
রাইসু ভাই বললেন, হ্যাঁ, দরকার তো। আমরা গেমস এর ক্যাটেগরি রাখব। নতুন গেমস কী কী আছে?
আমি বললাম, জিটিএ-ফাইভ আসছে।
উনি বললেন, এইটা নিয়া তো একটা লেখা দেওয়া দরকার। কে লেখতে পারবে। কম্পিউটার গেমস নিয়া কেউ তো আপনার চাইতে ভালো লেখতে পারবে না, আপনি লেখবেন জিটিএ-ফাইভ নিয়া?
আমি বললাম, তা না হয় লেখলাম।
তখন জিটিএ-ফাইভ কম্পিউটার ভার্সন কেবল নামছে। গেমস নিয়া একটু ইনটেনসড আলোচনা হওয়ার কারণে আমার গেমস খেলার পুরাতন নেশা একটু একটু জীবিত হইতে চাইতেছে তখন। আমি বললাম, আমি তো জিটিএ-ফাইভ এখনো দেখিই নাই। কোনো আইডিয়া নাই। আমার তো গেমসটা একটু দেখতে হবে।
রাইসু ভাই প্রবল উৎসাহের সাথে বইলা উঠলেন, জিটিএ-ফাইভ তো আমাদের খেলাই উচিৎ।
আমি বললাম, ডেফিনেটলি। আমি পরিচিত একটা দোকানে ফোন করলাম ডিভিডির জন্য। রাইসু ভাই একজনরে বললেন আসার পথে ওই দোকানে যাইয়া জিটিএ-ফাইভের ডিভিডি নিয়ে আসার জন্য।
দুই-তিন ঘণ্টা পরে জিটিএ-ফাইভের ডিভিডি আসল। রাইসু ভাই বললেন, বস, গেমস পরে। অন্য কাজের প্রায়োরিটি বেশি। এই কাজ শেষ হইলে পরে গেমস নিয়া বসেন। ডিভিডি ড্রয়ারে রাইখা দেন, নাইলে ওইদিকে আপনার মনোযোগ চইলা যাবে। আমি আমার উত্তেজনা কিছুক্ষণের জন্য চাপা দিলাম।
গেমসের সাথে আমার আর দেখা হইল না সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যায় বাসায় আসার সময় আমি গেমসটা নেওয়ার আগেই রাইসু ভাই বললেন, আমার কথা শোনেন, গেমসটা নিয়েন না। নাইলে আপনে সারারাত গেমস খেলবেন। কাল তো শনিবার, এইখানে তো আসবেনই, তখন ইনস্টল কইরেন।
আমিও ভাবলাম, গেমসটা নিলে রাতে আর পড়াশুনা হবে না। আমি জিটিএ-ফাইভ রাইখাই চইলা আসলাম।
পরেরদিন শনিবার। আমার ক্লাস নাই। সকালে গেলাম। অনেকক্ষণ পরে সেকেন্ড কম্পিউটার অন করে দেখি সেইখানে জিটিএ-ফাইভ ইনস্টল করা। আমি অবাক। আমি রাইসু ভাইরে জিজ্ঞাসা করলাম, জিটিএ-ফাইভ ইনস্টল করল কে ওই পিসিতে। উনি উত্তর দিলেন, খেলার জন্য, আমিই করছিলাম কাল রাতে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, খেলা যাইতেছে?
উনি বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন? উনি বললেন, ভালো আছে, গ্রাফিক্স অনেক উন্নত।
আরেকবার বাইরে গেছি, কী এক প্রসঙ্গে গেমসের কথা উঠছে। তখন মনে হয় আমি টম্ব রাইডার খেলতেছিলাম। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, এখনো গেমস খেলেন?
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, টম্ব রাইডার খেলছেন আগে কখনো?
উনি বললেন, না। আমার গেমস খেলা এজ অব এম্পায়ার পর্যন্ত।
একবার রাইসু ভাই সাথে ছিলেন। প্রিন্স অব পার্শিয়া সিনেমার পোস্টার দেইখা বললাম, এইটা আমার খুব প্রিয় একটা গেমস।
উনি বললেন, ভালো লাগে নাই।
আমি অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি খেলছেন প্রিন্স অব পার্শিয়া?
উনি বললেন, খেলতে নিছিলাম অনেক আগে, ভালো লাগে নাই। লাফাইয়া লাফাইয়া এক জায়গা থিকা আরেক জায়গায় যাইতে হয়।