স্যারের সঙ্গে দেখা হইল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৭ তলায় বাতিঘরে যখন মাসরুরের সন্ধ্যা অনুষ্ঠান শেষ হইছে আমরা বাইর হবো তখন। রাত প্রায় ১০টা। মাসরুর ছাড়াও আমাদের সেই আমলের বন্ধুরা সব একসঙ্গে নামবো নিচে, দেখি লিফট ভেদ কইরা স্যার বের হইলেন। সঙ্গে চামচারা কেউ নাই। নাকি ছিল?
স্যাররে মাসরুর বলল, স্যার চিনছেন, আমি মাসরুর। স্যার বললেন যে তিনি চিনছেন। স্যাররে একটু নিরব, থতমত লাগতে ছিল। কেন কে জানে। আমি মজা করলাম, “স্যার আমি সাজ্জাদ শরিফ।” সবাই হাইসা উঠলো। স্যার হাসলেন না।
অন্যেরে মজা নিতে দেওয়ার চাইতে স্যার নিজেই মজা করতে বেশি পছন্দ করেন। স্যাররে দেখতে সুন্দর লাগতেছিল। আগের মতোই হাসিখুশি আছেন।
স্যাররে বললাম, স্যার আমি আপনার আত্মজীবনী মূলক ইন্টারভিউর বইটা এইবার করতে চাই। দুই না তিন বছর মনে হয় আগেও একবার বলছিলাম, তখন কবি সাযযাদ কাদির সঙ্গে ছিলেন ওনার, ৬ না ৫ তলায় জানি। এখন নাই। সেইটা স্যারও বললেন।
কে কখন চলে যাবো।
উনি জানাইলেন আত্মজীবনী উনি লিখছেন। আর আমার ইন্টারভিউ নিয়া যে ওনার সন্দেহ—তুমি যে কী করবা শেষে!—এই রকম একটা ভাব দিলেন।
আমি বললাম, স্যার এখন তো আমি অত সমস্যা করি না আর, ভালো হইয়া গেছি।
স্যার বিশ্বাস করলেন না অত, তবে রাজি হইলেন।
২.
স্যাররে আমি ‘স্যার’ ডাকি সেই ১৯৮৮ সাল থিকা। আমারে স্যার তখন ডাকতেন, ‘জিনিয়াস’। হাস্যরস কইরাই।
আমি তখন বাড্ডা থাকি। ১৯৮৮ সালের বিখ্যাত বন্যায় বাসাবাড়ি ডুইবা ঘরের ভিতর পানি চলাচল করে। পানির মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে ইট বিছানো মেঝেতে ছোট মাছের যাওয়া-আসা। নৌকা দিয়া গলিপথ ভ্রমণ করি, টিনের চালে বইসা বর্ষা দেখি, কখনো আমাদের চাল থিকা টপকাইয়া পাশের বাসার বন্ধুদের ছাদে গিয়া উঠি।
তারও আগে থেকে আমি সাহিত্য করি। ১৯৮২ সালের পরে বই পড়াও কইমা আসছে। দর্শনের কিছু বই পড়ছি, ১৯৮৬/৮৭ সালে একটা নাটকের গ্রুপে (‘চিন্তন’—জহিরুল আহসান টিপু ভাইয়ের) অভিনয়ের খসড়া করি। এই গ্রুপের হইয়া ১৯৮৪ সালের দিকে গাইড হাউস মঞ্চে ‘গাব্বু খেলা’ নামে নাটকের দুই তিনটা শো’তে অভিনয়ও করছি আমি। এগুলির রেকর্ডিংও ছিল জনতা পত্রিকার শাহরিয়ার ভাইয়ের কাছে। ওনার সঙ্গে দেখা হইলে প্রতিবারই ওগুলির কপি আছে কিনা জিগাই।
তো, ওই বন্যার সময় আমি আর আমার বয়সে ছোট বন্ধু পিকাসো মিলা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাইতাম। পিকাসোর আব্বা ছিলেন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করা সাহিত্যিক-অনুবাদক। উনি মূল ফারসি থিকা অনুবাদ করতেন সম্ভবত। পিকাসোর বাসার শেলফে রাখা সব বই ততদিনে আমি প্রায় সবই পইড়া ফেলছি।
তো আমরা গিয়া দেখলাম বিশ্বাসাহিত্য কেন্দ্রে তখন মৌলিক উৎকর্ষ কার্যক্রম বইলা একটা কার্যক্রম চলে। ওইটাতে ভর্তি হওয়ার জন্যে ফরম ফিলাপ করে জমা দিলাম। পিকাসো বোধহয় দিছিল না। এক শুক্রবারে স্যারের সঙ্গে মোলাকাত হইল, এই বিষয়ে। আমার জমার কাগজে লেখা ছিল কী কী বই পড়ছি সে সবের তালিকা আর শখ। স্যার জিগাইলেন, তুমি বার্কলে পড়ছো?
বার্কলে আমি পড়ছি এইটে না নাইনে থাকতে, বন্ধু কবি মাতিয়ার রাফায়েলদের বাসা থিকা আইনা। ‘হাইলাস ফিলোনাস’ বইয়ের নাম।
বললাম, জ্বী স্যার পড়ছি।
কী বই পড়ছো?
স্যার ‘হাইলাস ফিলোনাস’।
কী বলে বার্কলে।
স্যার বার্কলে বলে, এই যে আমরা বইসা আছি টেবিলের সামনে এই টেবিলটা আসলে নাই, এইটা আমাদের সংবেদন দিয়া ভুল বোঝা।
স্যার বললেন, তুমি কী বলো?
আমি বুঝলাম স্যার আমার নিজস্বতা পরখ করতে চাইতেছেন। বললাম, আমি বলি আছে টেবিলটা।
তখন স্যার বললেন, তুমি তাইলে আসো, আমাদের কার্যক্রমে যোগ দেও।
কার্যক্রমে যোগ দিলাম। সেইখানে দেখি প্রায় কেউই আমার লগে কথাই কয় না। সব মিডল ক্লাসের বড়লোক হইতে চাওয়া পোলাপাইনেরা ধুমাইয়া সাহিত্য আর কালচার করতেছে।
অবশ্য বড় বড় কিছু মন্ত্রী আর রাজনীতিবিদদের ছেলেমেয়েরাও ছিল। সেই প্রথম আমার বড়লোকদের সঙ্গে মিশার আগ্রহের শুরু। সাহিত্য আর সমাজ নিয়া রাজনীতিরও।
১৫/৭/২০১৯
ছবি. অর্জয়িতা রিয়া