গরুর রচনা

[এই গরুর রচনাটা আমি লিখছিলাম কবি ড. মাসুদুজ্জামান ভাইয়ের কারণে। তিনি তখন ১৯৯২ সালে প্রকাশিতব্য ভোরের কাগজ পত্রিকার জন্য লেখা চাইছিলেন। ‘ইহা একটি উৎকৃষ্ট গরুর রচনা’ নামে লেখাটা তিনি ছাপান ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২-এ, ভোরের কাগজের ১ম বর্ষ ১ সংখ্যায়।]

 

গরুর রচনা সর্বদাই গরুর রচনা। কদ্যাপি উহা ছাগল কিংবা নদীর রচনা নহে।

সংজ্ঞা: বিশেষ্য। অকর্মক সেইসব প্রাণী যারা তাদের সম্মানিত লেজের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেন তাদের গরু বলা হয়।

সংঙ্গাহীনতা: উপযুক্ত সংজ্ঞার অভাবে অনেক গরুই আর শেষ পর্যন্ত গরুতে পরিণত হইতে পারে না। গরুর সংজ্ঞাহীনতার একটি পর্যায় আছে। সংজ্ঞাহীন গরুর আরেক নাম গাধা।

ভূমিকা: ভূমিসংলগ্ন সকল বন্তু ও প্রাণীর ২টি করিয়া ভূমিকা থাকে। একটি ব্যক্তিগত ভূমিকা ও অপরটি সামাজিক। গরুর ব্যক্তিগত ভূমিকা এই যে, সে ভূমি হইতে উৎপন্ন ঘাস ও আগাছা ভক্ষণ করে। আর সমাজে দুধ সরবরাহের মাধ্যমে গরু তার সামাজিক ভূমিকাটি পালন করিয়া থাকে। কিন্তু গরু কখনোই ছাগল নয়। তার এই দুইটি ভূমিকা ছাড়াও আরেকটি অতিরিক্ত ভূমিকা (যদিও হিংসুকগণ একে গরুর অহমিকা বলিয়া জ্ঞান করে) আছে। তা হচ্ছে জাবর কাটা–গরু জাবর কাটে–এটি হচ্ছে গরুর রাজনৈতিক ভূমিকা।

গরুর কাজ: গরুর চক্ষু আছে, ফলে সে ড্যাবড্যাব করিয়া তাকায়। গরুর দন্ত আছে কিন্তু সে কামড়ায় না। গরুর নাসিকা আছে, কিন্তু সে নাক গলায় না। আর গরুর আছে এক উত্তম কর্ণ ব্যবস্থা, যার কারণেই পৃথিবীর তাবৎ উপদেশবাক্য, সরকারী প্রেসনোট ও টিভি সংবাদসমূহ পঠিত হইয়া থাকে। আর গরু, শুধুমাত্র গরুই তা শ্রবণ করে আর শ্রবণ করে আর শ্রবণ করে। আর এই পৌনপুনিক সমস্যাটিকে বিশেষজ্ঞবৃন্দ জাবরকাটা বলিয়া অভিহিত করেন।

গরুর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমরা দেখতে পাই বাংলা প্রবন্ধ ও গবেষণা সাহিত্যে।

গরুর বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান: প্রত্যেক গরুরই আছে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এক নিজস্ব লেজ। যা গুটিয়ে ঘোট পাকিয়ে অবস্থান করে তার মস্তিকের কেন্দ্রস্থলে এবং বর্ধিত হয় আর তখন গরু যে কতো কথা বলে আর কথা বলে। আর তখন আমরা সেই সব ষাঁড়গর্ভ গরুবৃন্দকে সম্বোধন করি বুদ্ধিজীবী বলে।

গরুর হাস্যকর অসস্থান: আর গরু, গরু কখনো হাসে না–গরু হাসে না কারণ তার উপরের পাটিতে দাঁত নেই (আর তোমরা লক্ষ্য করিয়া থাকিবে–প্রাণীকূলের মধ্যে যাহারা বুদ্ধিজীবী উহারা কখনো হাসে না)।

গরুর দ্বান্দ্বিক অবস্থান: গরুকে যে খুঁটিতে বন্ধনযুক্ত করা হয়, তাকে বলা হয় বিশেষক্ষমতা আইন, আর্থসামাজিক সম্প্রীতি ও সংখ্যাগুরুর স্বার্থ ইত্যাদি; ফলে গরু এই সন্নিহিত খুঁটিব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে মুহুর্মুহু ঘুরিয়া যায়। এই ঘূর্ণন প্রক্রিয়াকে বলা হয় গতিশীলতা, আর এই ঘূর্ণন যখন বামদিক অবলম্বন করে তখন তাহাকে বলা হয় প্রগতিশীলতা, এই প্রগতিশীলতার চূড়ান্তরূপ দ্বন্দ্ব বা দ্বন্দ্বযুদ্ধ–ফলে চূড়ান্ত প্রগতিশীলরা লিপ্ত হন ষাঁড়ের লড়াই-এ।

ধর্মীয় অবস্থান: ধর্মের নামে যেসব ষাঁড় বেরিয়ে পড়েছে সদর রাস্তায় তাঁদের বলা হয় ধর্মের ষাঁড়। আর যে ষাঁড়গুলো শুয়োরের খোয়াড় অবধি গমন করে। আর গণতন্ত্রবিদগণ তখন এইরূপ বলে যে উহারা সংখ্যা গরুর ষাঁড়াংশ।

গরুর ঘোড়ারোগ: পৃথিবীতে আছে এক সর্বজনীন ঘোড়ারোগ। এই ঘোড়ারোগের প্রভাবে ময়ূরে পরিণত হয় কাক; আর দৈবাৎ যদি ময়ূরের ঘোড়ারোগ হয় সে পরিণত হয় বানরে। আর বানরের কোনো রূপান্তর হয় না। বানরের ঘটে বিবর্তন। সে তার সমস্ত সম্ভাবনা (!) সহ রূপ নেয় মানুষের। উল্লেখ্য, গরুর যখন ঘোড়ারোগ হয় তখন তার ঘাড়ে গজায় কেশর। আর সে তখন চায় সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণে আনতে। অদ্ভুত আর যা তার এখতিয়ারে নেই এমন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে সে তৎপর হয়ে ওঠে। সে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় শিল্পকলা, সাহিত্য, অভিনয়, সংস্কৃতি এমনকি অতিরিক্ত কড়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নজরুল ইসলামের কবিতাকে গোরস্তানে পরিণত করে। সে তার হাম্বা হাম্বা রবে ভরিয়ে তোলে প্রচার মাধ্যম। এবং কলুষিত এই ঘোড়ারোগ সারাবার জন্য আছে এক উত্তম দাওয়াই। শখের টাট্টুর কেশর ছেঁটে দিতে হয় আর তা করতে হয় নিয়মিত।

গূঢ়ত্ব: গূঢ় এই রচনার উদ্দেশ্য এই নয় যে গরুকে মানুষের সঙ্গে গুলাইয়া ফেলা। বরং মানুষকে বলা যেতে পারে অপূর্ণাঙ্গ গরু। অপূর্ণাঙ্গ গরুর লেজ নেই।

উপসংহার: গরুকে সংহার করা হয়। এ থেকেই জন্ম হয়েছে মহান এক কসাই শ্রেণীর। উহারা গরুকে কর্তন করে। গরুকে ভক্ষণ করে আর চারিদিকে শুধু গরুরই গোশত গরুর চামড়া গরুর হাড়।

গরুর রচনার বিকল্প: জগতে কিছুই অপরিহার্য নয়। সবকিছুরই বিকল্প রহিয়াছে (অবশ্য বিজ্ঞাপন অনুযায়ী মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নাই) যেমন টেলিভিশন দেখার বিকল্প নর্দমাদর্শন, ভোট দেয়ার বিকল্প ভোট না দেয়া, ঘোড়া পালনের বিকল্প ঘোড়ার ঘাস কাটা, ছাগল পালার বিকল্প আত্মহত্যা–সেইরূপ গরুর রচনারও বিকল্প আছে। গরুর রচনার বিকল্প ‘গাধার রচনা’। গাধার রচনা লেখা গরুর রচনার চেয়েও সহজ। শুধু কান দুটো টেনে লম্বা করে দিতে হবে।

গাধার রচনা

গাধার কান বড়ো বিধায় একে লম্বকর্ণ বলা হয়। গাধার কান কেন বড় হয় এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা হয় নাই। যারা যতোসব অদ্ভুত বিষয় যেমন রবীন্দ্র সাহিত্যে ঝড়বৃষ্টি, উইপোকার সমাজসচেতনতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন তারা এ বিষয়ে আগ্রহী হতে পারেন।

গাধা মূলত ঘোড়ার মতোই এক নৈয়ায়িক সৃষ্টি যেটি আবার দেখতে অনেকটা গরুর মতোই। এদের প্রত্যেকেরই চারটি করে পা, দুইটি করে কান আর একটি করে লেজ আছে।

কিন্তু গাধা বিশিষ্ট তার নৈতিক অবস্থানের কারণে। গাধা কখনোই কোনো হালকা বা নন সিরিয়াস কাজে আগ্রহী নয়।

এখন গরু, গাধা ও ঘোড়ার দৃষ্টিকোণ সংক্রান্ত নৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করা যাক: ধরা যাক একটি সংবাদপত্র, তা সে যে কাগজই হোক–এই তিন প্রাণীর সামনে দেয়া গেলো।
কি ঘটবে তাহলে? কি করবে এরা?

১) গরু: গরু হচ্ছে গরুরও অধম। সে এটি পড়ার চেষ্টা করবে এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে সে প্রথমেই চেষ্টা করবে গূঢ় রচনা-সমৃদ্ধ পাতাটি পড়ে ফেলতে।

২) ঘোড়া: ঘোড়া হচ্ছে পয়লা নম্বর ঘোড়ারোগী। সে এটি লাফিয়ে ডিঙ্গিয়ে সোজা দৌড়ে সচিবালয়ে চলে যাবে।

৩) গাধা: কিন্তু গাধা কখনোই গরু-ঘোড়া নয়। গাধার নৈতিকতাই হচ্ছে কোনো জিনিসকে বুঝতে চাইলে তার গভীরে পৌঁছার চেষ্টা অর্থাৎ আত্মস্থ করা, অর্থাৎ স্রেফ গিলে ফেলা। গাধা করবে কি–তার সামনে প্রদত্ত কাগজটিকে স্রেফ গিলে ফেলবে।

মানুষের মধ্যেও এটি লক্ষ্যে করা যায়। সে জগতকে খায়। নানাভাবে খায়।

বিকল্প রচনার মাধ্যমে আসলে গাধাকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। এমনকি গাধা ভক্ষণ করেও গাধাকে বোঝা সম্ভব নয়। গাধাকে বুঝতে চাইলে এসব গাধাদের সঙ্গে আপনাকে কথা বলতে হবে। এবং তা আপনি পারেনও, কেননা তারা আছে আপনার চারপাশেই–কান খাড়া করে।

১৯৯২