এক.
যখন রাত্রি হয় তিনি আসেন। হাতে ফুল। দেখি হাসছেন। আমিও হাসলাম। তিনি হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলেন। জিজ্ঞেস করলেন ভালো আছি কি-না। নাম জিজ্ঞেস করায় বললেন ‘ফুলিস’।
পরে জেনেছি, ফুল ভালোবাসেন বলেই এ-নাম। ভদ্রলোক এসেছেন দায়িত্ব পালনের জন্যে। জানতে চাইলেন কয়বার হয়েছে। আমি ‘না’ বলতেই তিনি দপ করে গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘যান গিয়া ঢোকেন এখনই।’
আমি টয়লেটে ঢুকতেই তিনি বাঁশি বাজাতে শুরু করলেন।
দুই.
মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক এলেন ফুল নিয়ে। ‘কী ব্যাপার, ফুল কেন!’ তিনি বললেন, ‘আই লাইক ইউ ভেরি মাচ, দয়া করে ফুলটুকু ফিরিয়ে দেবেন না।’
আমি নিলাম তাঁর ফুলটুকু, ‘আপনার বউবাচ্চা কিছু নেই?’
‘জ্বি আছে। বউ আছে। বাচ্চা নেই। নিজের বাগানের ফুল।’
‘ফুল খুব ভালোবাসেন বুঝি?’
‘না, তা না। আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগলো।’
‘আপনি থাকেন কোথায়?’
‘থাকি সামনেই থাকি। আমার ওয়াইফের বয়স ছাববিশ।’
‘ছাববিশ কেন?’
‘আমি জানি না।’
‘তাই নাকি? ঠিক আছে। নিয়ে আসবেন তাঁকে।’
‘ঠিক আছে।’ ভদ্রলোক হাত নাড়িয়ে চলে গেলেন।
পরদিন ভদ্রলোক আসলেন তাঁর বৌ নিয়ে। আজকে ভদ্রমহিলার হাতে ফুল। বললেন, ‘আমি খুব ফুল ভালোবাসি।’
আমি হাসলাম, ‘তাই? কী নাম আপনার?’
‘আমি জুলেখা’ ভদ্রমহিলা এমনভাবে উচ্চারিলেন যেন জ-এর মধ্যে ঢুকে গেছে আস্ত একটা অন্তস্থ য আর তালব্য শ।
আমি বললাম, ‘যুলেখা বাদশার মেয়ে।’
ভদ্রমহিলা তাঁর বুকের ওপর কী একটা দোলা দিলেন, আর কীভাবে যে দিলেন যে আঁচল খসে পড়লো তাঁর কোলের ওপর, আর হাসলেন হা হা।
আমি বললাম, ‘কতদিন হয় বিয়ে করেছেন?’
ভদ্রমহিলা তাঁর হাসি থামালেন, ‘জী ছ’ বছর।’
‘বাচ্চা নিচ্ছেন না কেন?’
‘ওর সমস্যা আছে।’ ভদ্রমহিলা তাঁর চোখ ঘুরিয়ে নিলেন তাঁর হাতের ফুলের মধ্যে।
‘এসব কি আর এখন কোনো সমস্যা?’
‘সে জন্যেই তো আপনার কাছে আসা।’ ভদ্রলোক মিষ্টি করে হাসলেন।
ফলে কারেন্ট চলে যায়। আমি মোমবাতি জ্বালি। ‘আপনার মাপ কত?’ আমি যুলেখার চোখের দিকে তাকাই। ভদ্রমহিলা তাঁর শাড়ি খোলা শুরু করেন।
আমি ভদ্রলোককে বলি, ‘আপনি বরং হাত দুটি ধরুন। আমি ঠিক নরমালি আনন্দ পাই না।’
ভদ্রলোক এসে তাঁর স্ত্রীর হাত ধরলেন। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘খানকির বাচ্চা!’
কাকে বললেন কে জানে।
তিন.
আমি যখন খেতের মধ্যে পাটের বীজ বুনছি, জানতাম না কেন বুনছি এই বীজ। মানে, জানার দরকারটিই পড়েনি। আমার বাপ, তার বাপ, তার বাপের বাপ সকলেই কেন কী করছে না-করছে সব বুঝে ওঠার আগেই নানাসমস্ত কাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছে।
ফলে, যখন পাটের গাছ ধীরে বড় হয়, আমি জানতাম না কেন বড় হয় গাছ। আর যখন কিছু পাটের গাছ এনে ভিজিয়ে দিলাম খালের পানিতে, আমার মন করে উঠল হু হু, আমি জানতাম না কেন, ভাবলাম চৈত্রের বাতাস। আর সেখান থেকে কিছু পাটের আঁশ আলগা করে দিলাম শুঁকোতে। তারপর দড়ি পাকানোর জন্য খুঁজতে গেলাম লাইলিকে। দেখি লাইলি মাছ ধরে।
আমি বলি, ‘দেখ লাইলি, এই যে কত পাটগাছ, আর তুই মাছ ধরিস।’
লাইলি বলে, ‘তোমার মনে রঙ লাগছে মামা।’
আমি বলি, ‘এই যে এত পাটগাছ বড় হয়ে যায়, জানিস কিছু কেন হয়?’
সে বলে সে জানে, আর আমার কানে কানে এমন আওয়াজ দেয় যে আমি তো আমি, আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর মাথা যায় বিগড়ে। আমি বলি, ‘চল লাইলি চল, দড়ি পাকাবি।’
আর আমরা গিয়ে ঢুকি একটা পাটখেতের মধ্যে। লাইলি বলে, ‘তুমি কি মামা এই গল্পেও সেক্স ঢুকাবা নাকি?’
আমি বলি, ‘না, অন্য কিছু।’
আর লাইলি করে কী, হাসতে হাসতে তার জামা-কাপড় ছেড়ে ছেড়ে ছিটকে ছিটকে বেরোয় আর আমরা ঘরে ফিরে আসি।
আমি বলি, মামা কী সর্বনাশ তুমি করলা আমার। মামা কিছু বলে না, আমি কাচারি ঘর থেকে সব পাকানো দড়িদড়া এনে গাছে গাছে ঝুলিয়ে দেই দেই দেই কিন্তু…
লেখকের আগমন
আমি করলাম কী, আগের গল্পে না পাওয়া দুটি ফুল দিলাম মেয়েটির হাতে ধরিয়ে। মেয়েটি, লাইলি, খুব বুদ্ধিমান, বলে, এই এক জিনিস পাইছেন আপনে।
‘তো, এখন আপনি কী করবেন?’
কী করবো মানে? আমারে ভোদাই ঠাওরাইলেন নাকি, আরে দেখেন না ভাই… আর করে কী, লাইলি, তার নিঃসঙ্গ ও উদোম পেট বাগিয়ে ধরে আমাদের সামনে–সেখানে জন্মশাসনের মার্কিনী বিজ্ঞাপন ও আমরা চুমু খাই।
চার.
ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দেন খসরু ভাই: চিনছো নাকি রাইসু, বিশিষ্ট মাগীবাদী লেখক।
আমি ভদ্রমহিলাকে হাতজোড় করি, ‘ক্ষমা করবেন দিদি, আমি থাকি একেবারে বিবর্জিত এলাকায়। তবে আপনাকে কোথাও দেখে থাকবো।’ এইটা ফাও মারলাম। একে আমি ইহজনমে কোথাও দেখি নাই। ‘কী নাম আপনার?’
‘সি কঙ্কা।’
‘ও আচ্ছা। মহান নাম। আগে শুনেছি।’ আমি ভদ্রমহিলার হাতে একটা রজনীগন্ধার স্টিক ধরিয়ে দিই। ‘শুভকামনা।’
ভদ্রমহিলা দণ্ডটিকে সাত-আট ভাঁজ করে পকেটে চালান করেন। ‘এইসব ফুল-টুল দিয়ে কিছু হবে না মিস্টার। ফুল মানুষের খাদ্য নয়।’
‘তা ঠিক। ফুল খাওয়া ঠিক হাইজেনিক না।’
এরপর সাড়ে তিন বছর পর তাঁর সঙ্গে আমার দেখা। লঞ্চে। তিনি বরিশাল যাচ্ছেন। বললেন, ‘বরিশাল খুব সুন্দর জায়গা।’
আমি ‘হ্যাঁ’ বললাম।
তিনি হাসলেন। ‘আপনার গল্পের ব্যাপারে কথা বলতে চাই আমি।’
‘জ্বী, প্রকাশেন।’
‘আপনার গল্পে তো জীবন নেই। শুষ্ক গল্প। না লিখলেই পারেন।’
আমি বলি, ‘এভাবে বলছেন।’
‘না। গল্প এক জিনিস। স্টান্ট আরেক জিনিস। জীবনের কাছে থাকুন। মানুষের কাছে থাকুন।’
‘জ্বী, তাই তো আছি। মানুষ তো আমার খুব পছন্দের। বিশেষত মেয়ে মানুষ।’
‘ঐখানেই তো আপনাদের সমস্যা। মেয়ে মানুষ! পণ্য হিসেবে দেখেন নাকি মেয়েদের?’
‘জ্বী। তা দেখি। উত্তম পণ্য।’
এবার ভদ্রমহিলা রেগেছেন। তাঁর কেশর ফুলিয়ে ঠকাঠক পা ঠুঁকে গর্জাতে লাগলেন।
সম্ভবত এসব কারণেই আমাদের লঞ্চটি ডুবে গিয়ে থাকবে।
১৯৯৩; সংবেদ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪ সংখ্যায় প্রকাশিত