ব্রাত্য রাইসুর বয়সের সংখ্যাটি পঞ্চাশে পৌঁছুবে এ বছর, এই উপলক্ষে কবিকে নিয়ে এই প্রথম কিছু লেখার অবকাশ হলো আমার।
আমরা নব্বইয়ে যারা সাহিত্য ও চিন্তার উঠানে পারা দিয়েছি তাদের মধ্যে একে অন্যকে উদযাপন না করাই রীতি। বন্ধুর কীর্তি উদযাপন করাকে নব্বই নির্বিশেষে নাম দিয়েছিল বন্ধুকৃত্য—ফলে আমার উপর ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুর বারণ ছিলো তাদের সৃষ্টি নিয়ে লেখা—কারণ ওরা জানে আমার পর্যালোচনা আস্বাদনবাদী—প্রকাশিত কাজের মধ্যে যা আমার ভালো লাগে তা নিয়ে বলি, যা ভালো লাগে না তা নিয়ে বলার প্রয়োজন মনে করি না—ফলে তা বন্ধুকৃত্য বলে তকমা পেতে বাধ্য।
সমসাময়িকদের কাজ নিয়ে লেখা সেই শর্ত রাইসুতে প্রযোজ্য নয়—কেননা ওর সঙ্গে বাতচিতের সাক্ষাৎ হয়েছে আমার একবার, যদিও ওর কবিতার পাঠক আমি প্রায় কুড়ি বছর ধরে। বলা দরকার যে, রাইসুর চিত্রকলারও আমি ভক্ত এবং ওর চিন্তাবাহী কুতর্কেরও আমি গ্রাহক, তবে সে বিষয় আজ বলব না। আজ ওর মনুষ্য জীবনের অর্ধশতাব্দী পূর্তির এই লগ্নে ওর কবিতা পাঠ থেকে আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা পাঠকের সঙ্গে বাটোয়ারা করব।
আহমেদ শামীম
তখন আমি জাহাঙ্গীরনগরে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র—নীলক্ষেতে যাই চৌধুরীর দোকানে, একটা বই দিয়ে আরেকটা বই নিয়ে সবুজ বাসে করে ফিরি সবুজ ক্যাম্পাসে—আই এ রিচারড, এফ আর লেভিস, টি এস এলিয়ট আর টেরি ইগলটনদের সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করি—কোথাও দাঁত বসাতে পারি কোথাও পারি না—ফলে তথাকথিত গ্রুপ স্টাডি করি। একদিন গ্রুপের একজন রাইসুর কথা পাড়ল—ঠিক কী বলেছিল মনে নেই—তবে ইতিবাচক কিছু নয়—ধরা যাক বলেছিল—”বঙ্গে ব্রাত্য নামে এক কবি আইছে, আর ঘোষণা দিয়া কইছে, “বেংলা কবিতার মায়রে চুদব।” আরও যা বলল কবির কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তাতে তথাকথিত চ-বর্গের ওই শব্দ দিয়ে একটা চলচ্চিত্র যেন তৈরি হল।
আমরা হাসলাম, দাশের “গলিত স্থবির ব্যাঙের” পাশে রাইসুর “আমরা নদীর মধ্যে বাউয়া ব্যাঙে করছি চোদাচুদি” রেখে আমরা হাসলাম, আর বললাম—বেংলা কবিতার বাপ এসে গেছে।
তার অনেকদিন পর, রাইসুর এক গুচ্ছ কবিতা পড়লাম একা—ভাবলাম রাইসুর কবিতা গ্রুপে পড়ার জিনিশ না। তারপর থেকে, রাইসুর কবিতা নীরবে পড়ে গেছি—যখনই হাতের কাছে পেয়েছি—বুঝতে চেয়েছি নব্বইয়ে সে কোথায় দাঁড়ায়, জানতে চেয়েছি বাংলায় কবিতায় রাইসুর স্ট্যাটাস। তো, কবি নিজে জানাচ্ছেন:
“নিতান্ত শায়িত আমি
কোথা আছি
কেউ তা জানে না শুধু মাছেদের রাষ্ট্রযন্ত্র তটস্থ সমাজ
তারা জানে আমার স্ট্যাটাস” (‘জলে মৃত্যু’-২)
এই পঙ্ক্তি রাইসু সম্পর্কে এটা অন্যরকম জানার আহ্বান করে। রাইসুর কবিতার বিষয়বস্তু ও কাব্যভাবের অনেক বৈচিত্র্যের মধ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা তটস্থ সমাজের পর্যালোচনামূলক ভাষ্য অন্যতম অথচ এই নিয়ে আমরা বন্ধুমহল বলতে গেলে নীরবই ছিলাম।
এর কারণও ছিল। রাইসুর হরেক রকম কবিতার মধ্যে কিছু কবিতা আড্ডা জমানোর উপাদান হিসাবে কাজ করত, ওগুলোই আলোচনাই আসতো বেশি—ওগুলো দিয়েই রাইসুকে চেনা ও চেনানোর চেষ্টা চলতো। চটুল রাইসু, চ-বর্গের পদাবলীর চলচ্চিত্রকার রাইসু এইসব। এইরূপ সাধারণীকরণের মধ্যে রাইসুর অ-সাধারণ কবিতাগুলো আমাদের কাছে থেকে দূরে লুকিয়ে থাকতো। রাইসু হয়তো এসব টের পেত, তাই লিখল—”হায় সাধারণীকরণ, ভাষাবিজ্ঞানের জাজ্জ্বল্য সমস্যা” (ছাগল)। রাইসুকে চটুল ভাবার আরও একটি কারণ হয়তো ছিলো ওর সোফিস্ট তরিকা এবং ভাঁড়ের ভূমিকা। কুতর্ক ও রসসিক্ত পর্যালোচনার কদর ছিল অতীতে একসময়, রাইসু তাদের বর্তমান প্রতিনিধি, ফলে নিজেকে নিজের গ্রাহক তৈরি করতে হয়েছে, তৈরি গ্রাহক সে পায় নি।
কবিতায় বেলায় হয়তো রাইসুর অত কষ্ট করতে হয় নি, কবিতার পাঠক তৈরি ছিল—তবে আরসব কবিদের মতো রাইসুরও সামনে চ্যালেঞ্জ হিসাবে ছিল জীবনানন্দ দাশ—আর তাঁর তৈরি করে দেয়া পাঠকের কাব্যরুচি। কী এক মজার কারণে দাশকে বাংলার পাঠক নাগরিক কবি হিসেবে নিতে নারাজ—অথচ দাশের চৌদ্দ আনি নাগরিকতা নিয়ে। ব্রাত্য রাইসু আগাগোড়াই নাগরিক কবি—সেই বাবদে দাশের পাঠক রাইসুকে নিতে না পারলে রাইসুর উষ্মা জাগাই স্বাভাবিক:
“পথেই তোমার দিবস ফুরাবে
বড়জোর তুমি জীবনানন্দের
গ্রেট কবিতাই পড়তে থাকবা
ভাবতে থাকবা গ্রামে গেছো গিয়া।
গ্রামে কারা পড়ে জীবনানন্দ? (রাস্তায়)
আমি ব্যক্তিগতভাবে জীবনানন্দের কবিতার ভক্ত। আমার কাছের বন্ধুদের মধ্যে একটা কমন বিষয় হল সকলে জীবনানন্দের নিবিড় পাঠক। জীবনানন্দ কেন ভালো লাগে এই কথার উত্তর আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রায় একই রকম—পড়তে যেমন ভালো লাগে, তেমন পড়ার পর অনেক কথা মনে জাগে। বন্ধুদের বাইরে শহীদ কাদরীকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম এই প্রশ্ন—তিনি বলেছিলেন জীবনানন্দ তাঁকে সিডিউস করে। ব্রাত্য রাইসুর কবিতা কেন ভালো লাগবে? বা লাগে?
তখন পর্যন্ত রাইসুর কবিতা নিয়ে আলোচনা যা পড়েছি তা ছিল ওর ভাষা নিয়ে, স্টাইল নিয়ে। বাংলা কবিতার নতুন বাঁক ব্রাত্য রাইসু—থেকে শুরু করে ব্রাত্যর কবিতা হয় নাকি পর্যন্ত পেয়েছি—তবে সেগুলোর ভরকেন্দ্র ছিল ভাষার এবং বিষয়ের ট্রিটমেন্ট বিষয়ক, ভাব বা বিষয়বস্তু নিয়ে নয়। কবিতা প্রসঙ্গে নব্বইয়ের বিশ্বাসই ছিল হীরার কাটটাই হীরা, বস্তুটা নয়। আমি অবশ্য মনে করি কাট এবং বস্তু দুই-ই গুরুত্বপূর্ণ। কাটের কথা অনেক হয়েছে, আজ তাই, কেবল বস্তু নিয়েই কথা বলব। কথা বলব রাইসুর দেখা স্বপ্ন ও বাস্তব নিয়ে।
“কেন সরু রাস্তা হেঁটে গেলে
হসপিটাল দেখি?
স্বপ্নে আমি এত বার হাসপাতাল দেখি!” (স্বপ্নে আমি কে)
মৃত্যুর চেয়ে মারাত্মক বিষয় আর কী হতে পারে। কবি কেন এত বার হাসপাতাল দেখেন স্বপ্নে? যে কবি কবিতায় চ-বর্গের পদাবলীর চলচ্চিত্র চলে বলে জেনে এসেছি, তার স্বপ্নের উপাদান তো অন্য কিছু হবার কথা ছিল, গুলশান বনানীর বেডরুম, নিদেনপক্ষে নিষিদ্ধপল্লীর কামরা, হাসপাতাল কেন, এত বার কেন? এইটা কি তার মৃত্যুচিন্তাপ্রসূত? ফ্রয়েড তা ভালো বলতে পারবেন। তবে, রাইসুর কবিতায় এমন ইঙ্গিত আছে যা পাঠে অনুমান হয়, এ কেবল ব্যক্তির মৃত্যুচিন্তাপ্রসূত নয়, এমন স্বপ্ন রাষ্ট্রযন্ত্র তটস্থ সমাজের মানুষের মুহুর্মুহু মৃত্যু ঘটনা দ্বারা আলোড়িতও বটে। মৃত্যু যে কী নৈমিত্তিক বিষয় এখন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা যায় প্রায় সকল মৃত্যুই অপমৃত্যু—অপঘাতে মৃত্যু। কিছু মানুষ মরছে অবলীলায়, কিছু মানুষ যার ক্ষমতা আছে অর্থ আছে বিত্ত আছে তারা হয়তো ঠেকায় রাখছে মৃত্যু কিছু কাল। ফলে মৃত্যুতেও বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। কবি রাইসু সেটা ভেঙে দিচ্ছেন কবিতায়, বলছেন, “সকলের মৃত্যু ভালো/ তাই মৃত্যু হোক সকলের—।” এমনসব মৃত্যু চাইছেন কবি, পড়ে মনে হবে এ কোনো কবি নয় বরং এক হৃদয়হীন হায়বানের অভিসম্পাত। কিন্তু, এমন কী করে হয়! তার জবাব আছে ওই কবিতাতেই: প্রতিদিন শত শত অপমৃত্যু মানুষকে অবশ করে দিয়ে গেছে, তাই—
“একটি মৃত্যুও আর
মৃত্যুরূপে প্রতিভাত
না হয় কখনো।” (মরণ ভালো)
স্বপ্নভঙ্গের মৃত্যুমুখর রাষ্ট্রেই অমন কবিতা সম্ভব। কবি দেশ কালে বাস করেন, স্বদেশ সমকালের সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় আশয় থেকে বিমুখ থাকা তার সম্ভব হয় না—কবিতায় কখনো উপমায় কখনো সরাসরি হাজির হয় কালিক অভিজ্ঞান। আমাদের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তকেরা কেমন ভূমিকা রাখে তা গুরুত্বপূর্ণ। গজদন্তের মিনারবাসী শিল্প-জগতের মানুষের কাছে সেই সত্য সহজে ধরা পড়ে না। নব্বইয়ের কবিদের মধ্যে যাদের কবিতায় রাষ্ট্রচিন্তার পর্যালোচনা উঁকিঝুঁকি দেয় তাদের মধ্যে রাইসুর অন্যতম। রাইসুর কবিতার মধ্যে রাষ্ট্রযন্ত্রের ছবি দেখি। একটি সমাজ যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের ত্রাসে তটস্থ থাকে তখন বুঝতে হয় সেই সমাজের বৈষম্য এমন এক পর্যায়ে আছে যেখানে প্রকৃতির নেয়ামত বৃষ্টিও শ্রেণিবিভক্তির চিত্র আঁকে। ‘এই দেশে বৃষ্টি হয়’ এবং ‘এই যদি গ্রামবাংলা’ কবিতাদ্বয় থেকে সেই চিত্রগুলো পাশাপাশি সাজানো যাক—তিনটি চিত্রে তিনটি শ্রেণির বর্ষা যাপনের চিত্র চোখে পড়ার মত:
চিত্র ১:
“… আমরা বিনীত জনগণ
নিমীলিত নেত্রে দেখি ভাবের জগতে
সদা বৃষ্টিপতনের
কী এক মহড়া চলছে! রুইকাতলারাঘববোয়াল
সব ভেসে উঠছে চারিধারে, বারিধারা ভেসে যাচ্ছে
মুহুর্মুহু পয়সার ঠেলায়…” (‘এই দেশে বৃষ্টি হয়’)
চিত্র ২:
“…আমরা গরিষ্ঠ জনগণ
অনাহারে অর্ধাহারে ভেসে যেতে চাই মেঘ
তোমার মতন; তবু
ভাসার ব্যাপারে হায়, আমাদের কিছুমাত্র
নিয়ন্ত্রণ নেই” (‘এই দেশে বৃষ্টি হয়’)
চিত্র ৩:
“হাঁটছে মাটির রাস্তায়
সিক্ত ছাগলের পাল—আর
ট্রেনের জানলায়—দেখা যাচ্ছে
মধ্যবিত্ত—জর্জরিত মধ্যবিত্ত
চিপস খাচ্ছে—চিপস খাচ্ছে—চিপস খাচ্ছে—আর
দেখে নিচ্ছে গ্রামবাংলা—আজিও বর্ষার ।” (‘এই যদি গ্রামবাংলা’)
এমন শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির প্রাদুর্ভাব ঘটে। আমরা সেই ঘটনার ঘনঘটা দেখি বাংলাদেশে—বিশেষ করে ঢাকা শহরে। ঢাকা শহরটা সকলেই জানে মুমূর্ষু—এর নাগরিকগণ যেন সেই মৃত্যুপথযাত্রী আত্মীয়ের সঙ্গ ছাড়তে চাইছে না। আবার এই মুমূর্ষু শহরে সবই যেন মরণাপন্ন। নানান রকম মরণ। রাইসুর ‘কোন প্রবীণ বুদ্ধিজীবীর সরকারপন্থী অকাল মৃত্যুতে’ কবিতার নামের মধ্যেই আছে একটা তির্যক মন্তব্য, সেখানে আমরা টের পাই—প্রবীণের অকাল মৃত্যু নয়, বরং বুদ্ধিজীবিতার অকাল মৃত্যু, সেটা হয় সরকারপন্থা অবলম্বনের কারণে। ওই তির্যক ইঙ্গিত কবিতায় অঙ্কিত হয় আরও বিস্তারিতভাবে—মোসাহেবির সমালোচনা:
“তারা, যা শুনতে চায়, না হয় আজকে তুমি তা বললা
তবে, তোমার কথা কবে তুমি বলবা গো?”
আবার যেসকল বুদ্ধিজীবী বলে, লেখে, বক্তৃতা দেয়—প্রভাষক-অধ্যাপক তারা যেন অনেক কথা বলে গিয়েও অবলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশ্লেষণ তারা হাজির করেন ঠিকই—কিন্তু সাধারণের কাছে সেটা দলীয় লেজুড়বৃত্তি হিসাবে ধরা পড়ে। লেজুড়বৃত্তি কথাটা কুকুরের সঙ্গে সম্পর্কিত—প্রভু দেখলে কুকুর লেজুড় নেড়ে লয়ালটি প্রকাশ করে। সেই বুদ্ধিজীবীদের লেখালেখি আর কর্মকাণ্ড দেখলে কুকুরের সেই লেজুড় নাড়ানো কথাই মনে পড়ে। ব্রাত্যের ভাষায়—
“বাসা পাহারা দেওয়ার জন্যে কুকুরেরা গলায় বেল্ট পরে বাসার সামনে চরকির মত ঘুরতে থাকে। তখন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবলা বুদ্ধিজীবীদের মত দেখায়।” (আমাদের সহজ পৃথিবী)
কেবল বুদ্ধিজীবী নয়, অন্যান্য দলগুলোর, বিশেষ করে বামদলের এবং তাদের উচ্চকণ্ঠ কর্মীদের ব্যাপারেও সমাজে নানাবিধ মূল্যায়ন হাজির আছে। বিপ্লবের গান তারা গায়, তারা সবাই যে নিয়মিত তা নয়, পার্ট টাইমার আছে, এ-দলের বি-টিম আছে, আবার বি-দলের আছে সি-টিম। তারা নিজ নিজ প্রভু-দলের বিপরীতে নিয়ন্ত্রিত বিদ্রোহ করে। ছোটো খাটো অসফল ঘটনা আর অঘটন বাদে এটাই বলতে গেলে বাংলাদেশের ইতিহাস—তারও ক্রিটিক রাইসুর কবিতায় জায়াগা পেয়ে যায়:
“তবু আমার মধ্যে তুমি
যত চাও পাইতে পারো
মিষ্টি অস্বীকার—
নিয়ন্ত্রিত বিদ্রোহ
আর
সরকারী হুঙ্কার।” (পার্টটাইম বিপ্লবীর গান)
এ তো গেল রাষ্ট্রের ভেতরটা। আধুনিক রাষ্ট্র তো আর ভেতরেরই কেবল নয়, বাইরেই বিছিয়ে থাকে। এ কালে বাংলাদেশকে বোঝা সম্পূর্ণ হবে না যদি ভারতের সঙ্গে এর সম্পর্ক মুলতুবি রেখে পাঠ করা হয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের সম্পর্কের রূপ কেমন হবে সেটা বাংলাদেশের সরকারের উপর অনেকটা নির্ভর করবে এটাই সত্য—এটাই দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক রাজনীতি-কূটনীতি প্রথম কথা। ফলে ভারত যদি বাংলাদেশের উপর চড়াও হওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করে, সেটা তৎকালের সরকারের ব্যর্থতা বলেই পরিগণিত হবে। সেবাদে রাইসুর পদে পাই—”ভারত বিরোধিতা বলে কিছু নেই/ আছে সরকার বিরোধিতা” (ভারত বিরোধিতা)। ভারতের প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শাসকমহলের, তাদের মোসাহেবদের সঙ্গে নিজের দুরত্ব তৈরি করেন কবি—রাজনৈতিক বক্তৃতায় নিশ্চয়ই নয়, তার কাব্যে-উপমায়। ভারত বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক, কোলকাতার সঙ্গে ঢাকার সাহিত্য ও রাজনীতির সম্পর্ক—যেন ইলিশের প্রতীকে রাইসুর কাব্যজালে আটকা পড়ে:
“নাকি কোনো গভীর জলে
একাকী গোপন ইলিশ,
কলকাতা যাব না!
আমার মানবজন্ম হেলায় গেল
ধুলাতে-বালিতে।” (‘আমি কি ফুল ফুটবো নাকি’)
অবশ্য রাইসুর রাজনীতি উপমার ভেতরেই শেষ হয় না। ক্ষেত্রবিশেষে সরাসরি হাজির হয় কবির রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং নিজের তৎপরতার ধরন। এই সমাজ রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া মৃত্যুকে বরণ করে নেয়, লজ্জায় কিছু বলতে পারে না, চাইতে পারে তার অধিকার। এটা আত্মহত্যা। সমাজ যখন মনে করে রাষ্ট্র বড় তখনই ঘটে বিপত্তিটা। রাইসুর বয়ানে পাই, “যারা অন্যদের নিজের চাইতে বড় ভাবে তারাই লজ্জা পায়, তারাই আত্মহত্যা করে।” এটা গরিবী বিহ্বলতা। নিজের শরীর না দেখতে পাওয়া হাতির ম্রিয়মানতা। একটি কিশোরী ভাতের অভাবে আত্মহত্যা করলে সে পুরো সমাজের উপমা হয়ে ওঠে। খবরের পাতা থেকে সে খবর রাইসুর কবিতার খাতায় জায়গা নেয়, তার রাজনৈতিক দর্শন ও সে দর্শন বাস্তবায়নের পন্থাসহ:
“জগতের সব কিছুতে সবার সমান অধিকার।
আসেন ঠিক করি, আমরা ভাত চাইতে আর লজ্জা করব না কোনোদিন। কারণ ওই ভাত আমাদেরও।”
(‘একটু ভাত দিবেন’)
রাইসুর কাব্য ভাণ্ডারে বিবিধ রতন, তবে মানবের মুক্তির মণিমুক্তাগুলোর আলাপ তেমন হয় না বলে আজকে আমার আলোচনার মালা গেঁথেছি সেগুলোতে। এতে হয়তো দুই বসুর, সুভাষ ও বুদ্ধদেব, দুই রকম প্রতিক্রিয়া হবে—রাইসুর কবিতা নিয়ে, কিন্তু সেখানেও বিবেচনা দরকার—এটা রাইসুর কবিতার অন্যতম প্রধান ধারা বটে তবে একমাত্র নয়। রাইসুতে অবগাহনের আরো ধারা আছে। আজ কেবল একটি নিয়ে আলোচনা হল। এবার একটি পুনর্বিবেচনা দিয়ে শেষ করা যাক। রাইসুর কবিতা আসরেও পড়া যায়। নিউইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাগুয়ার্ডিয়া কলেজে আধুনিক বাংলা সাহিত্য পরিচয়ের ক্লাসে বাংলাদেশের নব্বইয়ের কবিতা পাঠের একটা ব্যবস্থা করেছিলাম। সেখানে বাইশজন শিক্ষার্থীর সামনে পড়েছিলাম ব্রাত্য রাইসুর ‘মরণ ভালো’ কবিতাটি। পড়া শেষ হলে, সকলে করতালিসহ উঠে দাঁড়িয়ে কবিতাটিকে সম্মান জানিয়েছিল। সে এক অভিজ্ঞতা বটে।