মজিব কই রইলা রে বাংগালিগো থুইয়া
বাংগালিরা মরতে আছে ছিডা গুললি খাইয়া
মজিব কই রইলা রে!
এইটা একটা গানের শুরু। মতলবের ছেঙ্গার চরে নানাবাড়িতে গিয়া শোনা এই গান। ১৯৭৪ সালে। বড় মামা আওয়ামী লীগের এমপিগিরি করতেন তখন। আগে শেখ মুজিবের লগে জেল খাটছেন কয়েকবার। নারায়ণগঞ্জে বিস্তৃত বাড়িতে বসবাস করতেন। আম্মার লগে মনে হয় দুই বার গেছিলাম ওই বাড়িতে। ‘৭৫-এর আগে। চাকর বাকর আর সরকারে ঠাসা বাসা। দেখতাম মামার ছোট ছেলে মুখ আর হাতভরা খাবার খাইতে খাইতে রুমের পর রুম থপ থপাইয়া দৌড়ায়। পিছনে চাকরের দল। আমরা গরীব মানুষের নিরব ছেলের মতো শান্ত যাইতাম ওই বাসায়।
আমার শার্ট আর হাফপ্যান্ট আম্মা হাতে চলা সিঙ্গার শিলাই মেশিনে তৈরি করতেন। আরো পরে, ক্লাশ সেভেনে পড়ার সময়ে, ১৯৮০ হবে বা, টাঙ্গাইলের নাগরপুরের ধর্লা নদীর পারে ধর্লা নামের গ্রামে একবার আমার ফুপুর টাঙ্গাইল শহরে বসবাস করেন এমন আত্মীয়রা আমার এই হাতে বানানো শার্ট পরা লইয়া কিছু হাসাহাসি করছিলেন। আমি তখন দিনে-দুই-বই-শেষ-করা লেখকম্মন্য পাঠক। ওই বাড়িতে পাওয়া কৃষণ চন্দরের আমি গাধা বলছির অনুবাদ পড়তাম আর বিকালে যাইতাম নদী দেখতে। ফুপুর দেবররা ঢাকার সদরঘাট বাংলাবাজারে প্রুফ দেখতেন একটা সময়। হয়তো সে কারণেই অনুবাদ সাহিত্যের এই ধর্লা ভ্রমণ। তো নদীপাড়ে গেলেই আমার মনে পড়তো “তোমার বগা বন্দি হইছেন ধর্লা নদীর পারে রে!…”
তো ধললা নদী–ওই নামেই পার হইতাম নদী, যখন এলাছিন নাগরপুরে যাইতাম। ফলে হাসি আমারে ধরাশায়ী করতে পারে নাই। আমার সেই আমলের একটা ড্যাবডেবা ফটো আছে। খুঁইজা পাইতে হবে।
মুজিব যেদিন মারা যান সেদিন কী কারণে জানি না ছোট মামা আমাদের বাড্ডার বাসায় আছিলেন। বাড্ডায় আমাদের বাসাটা থাকতো রাস্তার পাড়ে।
শীতে কয়েক ইঞ্চি পুরা ধুলার রাস্তায় অল্প গাড়ি চলতো আর গরমে প্যাক আর প্যাক। তাতে মানুষের পায়ের ছাপ গিজগিজ করতো। আর কাদার মধ্যে কী একটা গাছের বেগনি রঙের ফুল পইড়া থাকতো। বাসার চারদিকে বাঁশের বেড়া দেওয়া। পাশে বড় খালাম্মাদের বাসায় যাওয়ার জন্য খোলা জায়গা। এই বেড়া দেওয়ার সময় কামলা নেওয়া হইত। আব্বা তাদের সঙ্গে কাজ করতেন। তারা বাঁশ কাইটা বেড়া গাঁথলে পরে বাঁশের খুঁটি গাইড়া তাতে বেড়া লাগানো হইত। দুপুরে কামলারা খাইতে গেলে আব্বা আমারে রাস্তার ধারটায় দাঁড় করাইয়া ভিতর থিকা বেড়ার ফাঁকেতে তার দিতেন, আমি খুঁটির দূরত্ব আন্দাজ কইরা তার ফেরত দিতাম। আমরা তার বলতাম, আমার খালাত ভাইরা বলতো গুনা।
পেয়ারা গাছ থাকত একটা উঠানের পাশে, চাপকলটা থাকত তার নিচে। বরই গাছও একটা, বাড়ির সামনে ছিল, রাস্তা ঘেইষা। যুদ্ধের পরে যখন আমরা কুমিল্লা থিকা ঢাকায় আসলাম তখন আমার খালাতো ভাইবোনরা সবাই সার বাঁইধা ওই বরই গাছের নিচে দাঁড়ায় ছিল, যতদূর মনে পড়ে। তবে বরই গাছ নিজেও তখন ছোটই ছিল।
কাঠের একটা চেয়ার পাইতা রেডিও শুনতেছিলেন মামা। এর আগে ছোট খালাম্মা আর উনি মিলা একদিন দরজার দুই পাল্লায় চাপা দিয়া একটা বিড়াল মারছিলেন। বিড়ালের মরণ চিৎকারে আমরা ভাইবোনরা সন্ধ্যার পড়া থুইয়া হত্যাদৃশ্য দেখতেছিলাম। অনেক আনন্দ নিয়া ওনারা বিড়াল মারতেছিলেন। বিড়াল যতই ছটফটায় ওনারা দরজার পাল্লা শক্ত কইরা ধইরা ছিলেন, ছাড়েন নাই। মরার পরে প্রাণহীন বিড়াল দরজা থিকা ঝইড়া মাটিতে পড়ছিল। আমাদের বাসায় ছিল টিনের চাল, ফ্লোর মাটির, মাঝে মাঝে তা লেপা হইত। লেপলে মাঝারি মাঝারি বৃত্ত তৈরি হইত মেঝেতে। গোবর মেশানো কাদামাটির একটা গন্ধ তখন থাকত। সে আমলে এবং পরে আরো বহুদিন আমি ঘরের চালে উইঠা দূরের বর্ষা দেখতাম।
তো ছোট মামা উঠানে রৌদ্রের মধ্যে কাঠের চেয়ারে বইসা রেডিও শুনতেছিলেন। হঠাৎ শেখ মুজিবের হত্যাসংবাদ শুইনা চিৎকার দিয়া কান্দা শুরু করলেন। চোখ দিয়া পানি পড়তে ছিল তার।বয়স্ক লোকদের কান্না, এখনও দেখছি, কসমিক হতাশা তৈরি করে আমার মধ্যে। আর আমি তো তখনও বাচ্চা। তার কিছু দিন আগে আমার খালাতো ভাই মোহাম্মদ আলী ও লিয়াকত আলী শেখ মুজিবের লগে হ্যান্ডশেক কইরা আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব বাড্ডাতেই কোথাও খেলাঘরে আসছিলেন, বাচ্চাদের সঙ্গে হাত মিলাইতে। আমি কেন যে খেলাঘরে ভর্তি হইছিলাম না তখন তা নিয়া দুঃখবোধ হইছিল। খালাতো ভাইরা কথা দিছিল, এরপরে প্রধানমন্ত্রী আসলে আমারে হ্যান্ডশেক করতে নিয়া যাবে। ছোট মামার আহাজারি দেইখা বুইঝা ফেললাম এই জীবনে আর শেখ মুজিবের লগে দেখা হইতেছে না।
শৈশবের অপ্রাপ্তিজনিত দুঃখবোধ আমার আরেকবার হইছিল। সেইবার গেছিলাম দাদাবাড়িতে। কুমিল্লার বাশরা গ্রামে।আমি তখন বোধহয় ক্লাশ টু কি থ্রিতে পড়ি। স্কুলের ছুটিতে গ্রামে গেছি। মাসখানেক ছিলাম কি সেইসময়? সবচেয়ে খারাপ লাগতো সূর্য না ওঠা। আর পুকুরে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করতে হইত। বিকালেও সূর্য নাই। সেই সময় একদিন আমি আর আরেকটা ছেলে–নাম খাইয়া ফেলছি–টিনের চালে উইঠা শিম পাড়তে ছিলাম। নতুন টিন। পিছলা। এক সময় সঙ্গের ছেলেটা পিছলাইয়া স্লো মোশনে ঘরের চাল থিকা মাটিতে পইড়া গেল। পইড়া অজ্ঞান। তো লোকজন করলো কী ওরে ধইরা নিয়া পাশের পুকুরের পানিতে ফেলাইয়া দিল। পানিতে পইড়া সাতরাইতে সাতরাইতে ওর হাড়গোর ঠিক হইয়া থাকবে। ও সাতরাইয়া উল্টা পাশে গিয়া উঠলো।
সে সময়ই মনে হয়, একদিন আমি দাদির সঙ্গে গেছি কোনো এক আত্মীয়ের বাসায়। পাঁচ ছয় মাইল দূরে। দাদি আর আমি হাঁইটা হাঁইটা যাইতাম। অনেক ক্ষেত, রাস্তা, আইল, নদী, খাল, চক পার হইয়া আমরা যাইতাম। একদিন ওইখানে ছিলামও। গ্রাম আমার ভালো লাগতো না। বিষণ্ণ লাগতো। পরদিন ফিরা আইসা শুনি আব্বা আসছিলেন। আমারে না পাইয়া আবার চইলাও গেছেন। আমি এই ঘটনায় অনেক দুঃখ পাইছিলাম। একটা বিস্কুটের প্যাকেট আব্বা নিয়া আসছিলেন আমার জন্য। আমি সেই প্যাকেট হাতে নিয়া ফোপাইতে ফোপাইতে অনেক কানছিলাম। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় বাচ্চা বয়সের দুঃখ অনেক গভীর, শারীরিক। কারণ বাচ্চাদের কোনো ওয়ে আউট থাকে না। দুঃখে বাচ্চাদের গলা আটকাইয়া যায়।
তো মুজিবের মৃত্যুর পরে বড় মামা নিঃশেষ হইয়া গেছিলেন। অন্য মামাদেরও দাপট কমতে থাকে। উনি আর দল বদল করেন নাই। পরে আওয়ামী লীগেরও কৃপা তিনি কেন জানি পান নাই আর।
মামারা লঞ্চ ভাড়া কইরা নারায়ণগঞ্জ ঘাট থিকা মতলবের ছেঙ্গার চরে যাইতেন। চুয়াত্তরে ওনাগো লগেই গেছিলাম আমরা–আমরা ভাইবোন তখন ছিলাম তিনজন; আর আম্মা। আব্বা ছুটিতে আসবেন। লঞ্চের জানালা থিকা নদীর ঘোলা ঘোলা পানি দেখতাম যাইতে যাইতে। আর ভট ভট শব্দ। লঞ্চ গজাইরা পার হইয়া ছেঙ্গার চর বাজারে ভিড়ত, ছোট মামা টুপ কইরা নাইমা যাইতেন। আর সবাই লঞ্চে বইসা থাকতাম। লঞ্চ অতি ধীরে ঘুইরা উল্টাপার্শ্বে আসলে দেখতাম মামা বাজারে পাবলিক মোলাকাত সাইরা লঞ্চে উইঠা আসছেন। তখন জিনিসটা বিভ্রম লাগতো। কেমনে যে উনি ডাঙায় নাইমা আবার লঞ্চে উঠতেন তা বেশ যেন হয় নাই হয় নাই লাগতো। আমি তো তখনও পৃথিবী গোল হইলে যে বাজারে নাইমা আবার চলন্ত লঞ্চেই উইঠা পড়া যায় তা জানতাম না। তো মামা নাইমা আবার কীভাবে লঞ্চে উঠলেন শৈশবের সেই বিস্ময়রে বয়স্ক লোকরা পাত্তা দিত না। ওই সময় অনেক দিন ছিলাম নানাবাড়িতে। তখন এই গানটা শোনা হইত। সকালের দিকে রোদ একটু উঠলে গানটা গাইত ছেলেটা। নিজে নিজেই। কেউ শুনতোও না সেইভাবে। পোলিও হইছিল বোধহয় ওর। উঠানে মাটিতে রাখলে ঠাণ্ডা লাগবে ভাইবা বোধহয় ঘরের চালে রইদে দিয়া রাখতো ওরে। ওইখানেই গানটা গাইত।
মামারা নাকি যুদ্ধের পরে রাজাকার ধইরা পুকুরে চুবাইয়া মারতেন। চুয়াত্তরে শোনা। বড় মামার ভোটের উপলক্ষে নানাবাড়িতে গেছি। মামারা হ্যাজাক জ্বালাইয়া নির্বাচনী আবহাওয়ায় বইসা থাকতেন। আমরা বাচ্চারা ঘরের কার থিকা দুর্ভিক্ষের টাইমে সাহায্য হিসাবে আসা স্বাস্থ্যবান ফুটা ফুটা বিদেশী বিস্কুট চুরি কইরা খাইতাম আর পটকা নিয়া উঠানে ফুটাইতাম। তেমন একদিন সন্ধ্যাবেলায় বন্দুক পরিষ্কার করতে ছিলেন মামার এক চাচাতো ভাই। তাদের ঘরের বারান্দায় বইসা। ওনার নাম বোধহয় ছিল মোস্তফা। তো তার বন্দুক থিকা গুলি বাইর হইয়া এই মামার—ফেরদৌস মামা– উরুতে গিয়া লাগে। পরে বস্তা বস্তা পাহাইড়া লতা চটকাইয়া তার রস দিয়া রক্ত বন্ধ করতে হইছিল।
একটা ঘটনা নিয়া বেশ উত্তেজনা হইছিল তখন। বাড়ির পাশ দিয়া যে খাল গেছে তার মধ্যে খাটা পায়খানা আছিল একটা। পানি বেশ নিচুতে। দুই পাশে ঝোপঝাড়। বাঁশগাছ। পাশাপাশি ফেলায় রাখা দুইটা মোটা বাঁশ দিয়া সেইখানে পৌঁছাইতে হইত। দুই কামলা মহিলারে কে জানি দেখছিল পায়খানা থিকা এক লগে বাইরাইতে। তা নিয়া বেশ উত্তপ্ত অবস্থা। আমরা বুঝতে পারি নাই এই নিয়া এত উত্তেজনা করার কী আছে!
বাড়ি থিকা একটু দূরে কবরস্থানে গেছিলাম একদিন। নানা-নানির কবর দেখতে। ওই একবারই কবর দেখছি ওনাদের। নানানানি বইলা কোনো স্মৃতি বা সম্পর্কের বোধ তৈরি হয় নাই আমার মধ্যে কখনো। তবে সৎ নানি আছিলেন একজন। কেউ একজন জ্বিনের গল্প করছিল। যে জ্বিনরা নাকি বাড়ির এক কোনা থিকা কবরস্থানে উইড়া আসে বরই কাঁটা হইয়া। এর পরে অনেক দিন আমি ভাবতাম যে আমি নিজেই বরই কাঁটা উড়তে দেখছি কবরস্থানের দিকে।
তো ওই গায়ক ছেলেটার নাম আর মনে নাই আমার। গানটার বাকি লাইনগুলাও। এই গানটা আমার খুব প্রিয় একটা গান। শেখ মুজিবের নামও ঐ প্রথম শোনা। এখন তো ঐ নাম তেমন শোনা যায় না আর। এখন কেবলই বঙ্গবন্ধু।
২.
একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদ থিকা নামতেছি শাহবাগ যাব। সিঁড়িতে গান গাইতেছিলাম ‘মজিব কই রইলা রে’…
তো আমি তো বুঝি নাই নিচে হলরুমে সামওয়ান মুজিব একজন বইসা থাকবেন। উনি এই গান শুইনা ব্যক্তি আক্রমণ হিসাবে নিবেন। আর আমারে সেই দিনই শাহবাগে, সিলভানায়, ছোট গল্পকার সেলিম মোরশেদ আর ছোট কাগজ গাণ্ডীবের প্রকাশক হোসেন হায়দার চৌধুরীর সামনে ঘুষাইতে থাকবেন। তা বেশ আগের দিনের কথা। ১৯৮৯ সালের। ইশতিয়াক মুজিব অনেক দিন থিকাই কানাডায়। উনি বেশ লম্বা ছিলেন। ফলে তেরছা ঘুষি কম কম আঘাত করছিল আমারে।
৩.
১৯৮৯ সালেই বোধহয় আনোয়ার শাহাদাতের আসেদিনযায় পত্রিকায় প্রকাশিত একটা লেখার কারণে আমার বন্ধু ফাকরুল ইসলাম চৌধুরীর ফাঁসির দাবিতে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের মিছিল হয় শুক্রবার বাদ জুমা। ফাকরুল তখন অবস্থা রেকি করতে ইসলাম চৌধুরী নাম ধইরা গোলাম আযমের লগে সাক্ষাৎ কইরা আসছে। এবং ঢাকার খারাপ অবস্থায় সিলেট চইলা গেছে। আমার একদিন পরে যাওয়ার কথা। আমি অগ্রিম টিকেট কাইটা আইসা শাহবাগে বইসা আড্ডা দিয়া রাতে বাসায় ফিরছি। বাসায় গিয়া দেখি ট্রেনের টিকেট আর পাই না। সাজ্জাদ ভাইরে ফোন করলাম। যে ভুলে ওনার বইপত্রের লগে টিকেট গেছে কিনা। উনিও এই টিকেট দেখেন নাই। পরে ভোর চাইরটার সময় খুঁজতে আসছি শাহবাগে টিকেট–যদি পাই! দেখি নর্দমায়–পানিতে–ভাসমান–টিকেট–স্থির। হিঃ হিঃ, টিকেট ধুইয়া আমি কমলাপুর রওনা দিছিলাম। তখন ঐ সকালে বা আরো পরে ঐ একই জায়গায় এক টোকাইরে দেইখা বাক্যালাপের ইচ্ছা হইল। আমি জিগাইলাম–কারণ তখন অনেক এক্সপেরিমেন্ট আমার–আইচ্ছা বলো দেখি ‘সাহিত্য’ কারে বলে? সেই টোকাইর বাচ্চা টোকাই বলে কী: “সাহিত্য অইল–তোমার বাসা কোথায়?”!
ঢাকা, ৭/২/২০১১ – ৬/৩/২০১১