যদিও বলা হয়ে থাকে জনগণ রাজনীতি সম্পর্কে অনীহ এবং রাজনীতির ঘোরপ্যাচ সে কিছুই বোঝে না;–তবু, তথাপিও, পাঠক-জনগণ হচ্ছে সচেতন জনগণ। সে জানতে ইচ্ছুক, তাই সে পাঠ করে, আর তাই সে সচেতন। আর ব্যক্তির সচেতনতা হচ্ছে রাজনৈতিক সচেতনতা। এভাবেই বলা যায়, সেসব ব্যক্তি অর্থাৎ যারা জনগণ, ক্রমে সচেতন এবং ক্রমাগত রাজনৈতিক হয়ে ওঠেন।
আর তাই, যখন আপনি লেখেন একটি রচনা, আর তা যদি হয় অরাজনৈতিক, আপনার লেখা পড়বে না প্রায় কেউই–এক প্রুফ রিডার ছাড়া (প্রুফরিডাররা হচ্ছেন মহত্তম পাঠক, তারা সবকিছুই পড়েন)। আপনি হয়তো ভালোবাসেন চাঁদ, ফুল, ঘাস কিন্তু আপনার এই চাঁদ, ফুল আর ঘাস খাবে না পাবলিক, যতক্ষণ না এসবের মধ্যে আপনি রাজনীতি ঢোকাচ্ছেন। নিউজপ্রিন্টে মুদ্রিত হয়ে থাকবে আপনার ক্যাবলাকান্ত লেখাটি, মুদ্রিত হওয়ার পর পাঠকের দিকে ব্যাকুল তাকিয়ে থাকবে আর পাঠক তাকাবে আপনার লেখার দিকে তাচ্ছিল্য,ভয় আর বিস্ময়ের তৃষ্টিতে: রাজনীতি নাই লেখায়! এ লেখা আমি কেমন করে পড়ি!!
এখন আপনি যদি চান নিজের লেখা পড়ে নিজে মুগ্ধ হবেন। যে, এরকম একটা লেখা কীভাবে পারলেন আপনি লিখে ফেলতে। যে,পাঠক পড়ুক ছাই না পড়ুক–কতো কতো মণীষীর লেখাই তো পড়েনি পাঠক–কী হয়েছে তাতে ? যদি এভাবে স্বস্তি না পেতে চান তবে চাইলে আপনার লেখাটিকে চেষ্টা করতে পারেন গ্রহনযোগ্য করে তোলার-রাজনৈতিক করে তোলার। এমন লেখা লিখবেন যা পড়ে পাঠক মূহূর্মুহূ সচেতন বোধ করে,রাজনৈতিক বোধ করে। ‘রাজনৈতিক বোধ করা’ ব্যাপারটি খোলসা করা দরকার।
ছোটো তিনটি উদাহরণ দেয়া যাক। ধরা যাক আপনি লিখলেন:
প্রায়ই লোডশেডিং হয়।
এই লেখাটি একটি অরাজনৈতিক রচনা। এ ধরনের লেখা যত কম লেখা যায় ততোই জাতির জন্য মঙ্গল। ‘সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে’ যেমন অদরকারী ভাষণ, এটাও তাই। এধরনের বাক্য জনগনের কোনো কাজে আসে না।
প্রায়ই লোডশেডিং হয়, এর জন্য দায়ী কে?
এটি একটি রাজনৈতিক লেখা। এ বাক্যে দায়ী কিংবা দোষী ব্যক্তিদের খোঁজাখুঁজি করার একটা প্রবণতা আছে। কিন্তু দায়ী ব্যক্তিদের কেন খোঁজা হচ্ছে তার উল্লেখ নেই। ফলে এটি একটি আধা-রাজনৈতিক রচনা। বাংলাদেশ টেলিভিশনের অত্যন্ত চমৎকার ও হৃদয়গ্রাহী কিছু অনুষ্ঠান হয় (!) সেখানে সাপ্তাহিক নাটক (!!) বলে একধরনের মজার জিনিস দেখানো হয় ; যা জিনিসগুলি শেষ হয় একটি দু’টি বা তিনটি প্রশ্নচিহ্নের মাধ্যমে। এই বাক্যটি অনেকটা সেরকম। এ ধরনের জিজ্ঞাসাচিহ্নমূলক ক্যারদানি যেহেতু সম্প্রচার কেন্দ্রগুলোর একচেটিয়া–ফলে, এ-সব বাক্য উচ্চারণ না-করাই নিরাপদ।
প্রায়ই লোডশেডিং হয়,এতে জনগণের খুব কষ্ট হয়, জনগণের এই কষ্টের জন্য যারা দায়ী সেইসব দুস্কৃতকারী,সেইসব সন্ত্রাসবাদীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক চরম শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
এ লেখাটি যে অবশ্য অবশ্যই রাজনৈতিক,তা আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এ বাক্য পাঠ করলে মানুষ ‘রাজনৈতিক’ বোধ করবে। কেননা আপনার এ লেখায় আপনি জনগণকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। জনগণ বুঝতে পারছে যে হ্যাঁ আপনি তাদের নিয়েই লিখছেন। এ ধরনের লেখা প্রায়ই লেখা উচিত,পুনমুর্দ্রণ করা উচিত। সত্যি বলতে কী একমাত্র এ ধরনের লেখাই লেখা উচিত। আর সব বাদ দিয়ে।
অবশ্য ‘রাজনৈতিক’ বোধ করানোর ক্ষেত্রে মৃদু অসুবিধা আছে যে,আপনি আপনার জনগণকে কোন ধরনের ‘রাজনৈতিক বোধ’ দিতে চান। অনেক রকম ‘রাজনৈতিক বোধ’ আছে। যেমন: সরকারী ডান রাজনৈতিক বোধ/বিরোধী দলীয় ডান রাজনৈতিক বোধ/বিরোধী দলীয় বাম রাজনৈতিক বোধ/ সরকারের পদলেহী বাম রাজনৈতিক বোধ/হায় হুতাশমূলক বাম রাজনৈতিক বোধ/কেবলামুখী ডান রাজ-রাজনৈতিক বোধ ইত্যাদি।
এখন আপনি যদি এসবের মধ্যে যে কোনো মাত্র একটি ‘রাজনৈতিক বোধ’ নিয়ে লিখতে চান তাহলে বাদবাকী রাজনৈতিক বোধসম্পন্নরা পড়বে না আপনার লেখা। এ বাধাটা আপনি কাটাতে পারেন ‘আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক বোধ’ নিয়ে লিখে। বা ভালো হয় আপনি যদি দেখাতে পারেন যে পাঠকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে এক সার্বভৌম বিমূর্ত অশুভ শক্তি,যাকে সনাক্ত করাই সম্ভব নয়।
যদি একবার আপনি ধরে ফেলতে পারেন পাঠক জনগনের রাজনৈতিক নাড়িটি,তারপর ইচ্ছা করলে গ্রীষ্মকালের রচনায় শীতকাল,শীতকালের রচনায় বর্ষাকাল,বর্ষাকালের রচনায় সৌদি আরবের উটের জাহাজ-যা খুশী নিয়ে আসতে পারেন।
আপনি হচ্ছেন লেখন, স্রষ্টা (!) যা খুশি তাই নিয়ে লিখবেন,যখন খুশী তখনই লিখবেন। হয়তো লিখলেন,… আজ মন বড় খারাপ। মনে হয়তো ভাবলেনও কেন আমার মন খারাপ! তারপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন, দেখলেন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশা পড়েছে (অথবা হয়তো জানালা বন্ধ)। লিখলেন আজ কুয়াশা পড়েছে। আজ ঈষৎ ঠাণ্ডা। আজ কিছুই দেখার উপায় নেই।
এই প্রাকৃতিক রচনা আপনার এই বিমল নিসর্গপ্রীতিকে এবার রাজনৈতিক করে তুলুন। লিখুন: চারদিক আজ কুয়াশায় আচ্ছন্ন। এই কুয়াশা এই উদ্দেশ্যমূলক সাম্রাজ্যবাদী কুয়াশার চক্রান্তের বিরুদ্ধে আজ আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আজ আমাদের জেগে উঠতে হবে। আমরা অনেক অনেক দিন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। কেন কাটিয়েছি? ইচ্ছা করে ঘুমাই নি আমরা। আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। কে রেখেছে? আজ তা বলার দিন এসেছে। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে খাইয়ে অবশ করে রাখা হয়েছে আমাদের। আমরা আর ঘুমের ওষুধ খেতে চাই না। আমরা জেগে থাকবার অষুধ খেতে চাই। আমরা চাই সচেতন হতে,অথচ আমার মন খারাপ,অথচ দিনের পর দিন আমার ভালো লাগে না, একঘেয়ে লাগে। সিবা গেইগী কথিত বিষণ্ণতা হয়েছে আমার। আসলে ‘আমার’ ‘আামার’ বলাই আমাদের মুদ্রাদোষ। আমরা সবকিছুকেই ব্যক্তিগতভাবে দেখতে চাই,এই দেখার মধ্যে দোষ আছে। আসলে সবকিছুকে দেখতে হবে দ্বান্দ্বিকভাবে,পারলে ত্রিন্দ্বিকভাবে। অথচ আমরা চোখ থাকতে অন্ধ। আমরা দেখেও কিছু দেখি না, কেননা কুয়াশায় সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেছে। এই অ্যাশকালার কুয়াশার চরিত্র নির্ণয় করা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার জন্যে দরকার হলে আমরা রাজপথে নেমে আসবো। আর এই রাজপথ,এই মেঘে ঢাকা রাজপথ কারো বাপের সম্পত্তি নয়। অথচ এই রাজপথে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা, এর জন্যে দায়ী কে? দায়ী কে তাও আজ আমরা উচ্চারণ করতে পারি না। আমাদের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমাদের মুখে আলু পুরে দেয়া হয়েছে।
এরপর হয়তো আপনার এই উর্বর রচনাটিতে একটু ঐতিহাসিক দ্রব্যগুণ দেয়ার ইচ্ছা হলো। এরকম ইচ্ছা হতেই পারে। লেখক কোনো ইচ্ছাকেই দমিয়ে রাখবেন না। লিখুন…এই যে আলু, এই আলু চাষের উদগাতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অথচ তাকে দেখানো হয় ভুলভাবে। বাংলার অর্থনীতিতে তাঁর অবদানের কথা বেমালুম গাপ করে দেয়া হয়েছে। বাংলার ক’জন আলুচাষী তাঁর নাম জানে। এই যে বাংলার আলুচাষীরা রবীন্দ্রনাথের নাম জানলো না এর জন্যে দায়ী কে ?
যারা দায়ী, তাদের, সেইসব দুষ্কৃতকারীদের, সেইসব সন্ত্রাসবাদীদের খুঁজে বের করার, দৃষ্টান্তমূলক চরম শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
যে, ব্যবহারের কারণ
শিরোনামে যে অব্যয়পদটি আমি ব্যবহার করেছি সচেতনভাবে,অর্থাৎ কিনা রাজনৈতিকভাবে,এর ফলে শিরোনামটি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক শিরোনামটি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক শিরোনাম। আর এর নিম্নভূমিতে প্রকটিত রচনাটিও অবস্থানগত কারণে রাজনৈতিক–গ্রহণযোগ্য–এবং পাবলিক খাওয়া। জয় পাবলিক!
#
[গরুর রচনার অব্যবহিত পরে এই রাজনৈতিক রচনাটি আমি লিখি। ১৯৯২ সালের মে মাসের শেষদিকে ২৪ তারিখ, ঢাকা রবিবারে ভোরের কাগজ পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। / ব্রারা ১৫/২/২০১২]