আমরা যে-দিনগুলিতে কেবলই বৈচিত্রের সন্ধান, আর বলছি ভালো লাগে না ভালো লাগে না, তেমন দিনে যিনি আমাদের বুঝতে পারতেন তিনি থাকতেন সদাই গম্ভীর, ফলে প্রতিটা বিষয়েই তার ছিল নিজস্ব সব ভিন্নমত। আর যখনি আমরা তার কাছে গিয়েছি তো আমাদের চা দিয়েছেন বিস্কিট দিয়েছেন, বলেছেন, ‘শোনো, নতুন একটা চিন্তা এসেছে মাথায় কিন্তু তার আগে তোমরা ভাতটাত কী খাবে বলো, আমি লাইলিকে বলি।’ কিন্তু আমরা নিশ্চই করে জানতাম, তাঁর যে নতুন চিন্তা, তা মৃত্যুবিষয়ক। আমরা কখনোই বুঝতে পারি নি কারো একজনের মৃত্যু বিষয়ে কেন এত চিন্তা করতে হয়, এবং আমরা বলেছিলাম যে দুপুরে আমরা খাবো।
লাইলি, যেহেতু তাঁর মেয়ে এবং একমাত্র, সে বলে, ‘তোমরা ভাত খেতে এসছো বুঝি।’ আমরা ‘হাঁ’ বলতেই তিনি গম্ভীর মুখে বলতেন, ‘বুঝলে, আত্মহত্যা-করতে-চায় এমন কাউকে দেখলে আমার কাছে নিয়ে আসবে। এরা মৃত্যুকামনা থেকে একধরনের যৌনানন্দ পায়, আমি একবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম, করি নি কেন জানো?’ লাইলি, যেহেতু তাঁর মেয়ে, সে জিজ্ঞেস করে, ‘আনন্দের জন্য বুঝি?’
আমরা হাসি। হাসতে হাসতে কেউ দাঁড়াই। কেউ, ‘চায়ে চিনি কম দিয়েছো লাইলি, ঘটনা কী?’ কেউ, ‘কিন্তু ফ্রয়েডের সব কথাই মেনে নেয়ার কোনো কারণ আছে কি?’
তিনি কখনো হাসেন না। মৃত্যুচিন্তা যিনি করেন, তার মুখে হাসি শোভা পায় না। ফলে তাঁর মেয়ে একাই হাসে। আমরা ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসি।
২.
আমরা তাঁর ঘর ছেড়ে সোজা হেঁটে যাই। সামনে যে-বাসা, নক করি। দরজা খোলে। ভেতরে ঢুকি। আমরা হাসি। ঘরভর্তি লোকজন। আমাদের বসতে বলে। বলে, ‘আপনারা বসুন। আমরা আত্মহত্যা করতে চাই।’ আমরা পরিবারটিকে লাইলির বাবার কাছে নিয়ে আসি। লাইলির বাবা বলেন, ‘আত্মহত্যা হচ্ছে নিজেকে ধবংস করার প্রবণতা। মর্ষকাম। এর সঙ্গে যৌনতা জড়িত।’
যৌনতার কথা ওঠায় আমাদের সবারই উত্তেজনা হয়। আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল যে-পরিবারটি তার সব সদস্যরা নগ্ন হয়। লাইলি নগ্ন হয়। লাইলির বাবা নগ্ন হন। লাইলি হাসে। একাই, এবং বলে, ‘এ ধরনের গল্প আসলে পর্নোগ্রাফি।’
আমরা স্বীকার করি। লাইলির বাবা, যেহেতু প্রধান চরিত্র, বলেন, ‘পর্নোগ্রাফির ইতিহাস তোমরা জানো নাকি কিছু?’
লাইলি হাসতে হাসতে বলে, ‘আসলে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।’ যেন এই প্রথম কেউ স্বপ্ন দেখলো, এবং আমরা যৌনানন্দ থেকে ফ্রয়েড-মারফৎ স্বপ্নের মধ্যে চলে আসি।
‘কী স্বপ্ন তুমি দেখলা লাইলি?’
লাইলি বলতে রাজি হয় না। পরে বলে, সে দেখেছে হুমায়ূন আহমেদকে। তিনি পশুপাখির সঙ্গে কথা বলছেন।
আমরা হুমায়ূন আহমেদকে ফোন করি। কে এক পিচ্চি ফোন ধরে, ‘কী চাই?’
আমরা বলি, ‘হুমায়ূন আহমেদ সাহেবকে আমরা চাই। তিনি কি আছেন?’
এবার অপেক্ষাকৃত খসখসে ও বয়স্ক কণ্ঠ, ‘হুমায়ূন তো নেই। ও বাচ্চাদের নিয়ে জিরাফ দেখতে গেছে।’
আমরা লাইলির বাবাকে জিজ্ঞেস করি, জিরাফ দেখার ক্ষেত্রে কোনো আইনগত নিষেধ আছে কি না, বাচ্চাদের। তিনি বলেন, এগুলো আসলে তেমন জরুরি কিছু নয়।
‘কিন্তু আপনি আত্মহত্যা করতে গেলেন কেন?’
‘সে সব আমি বলতে চাই না।’ আর তিনি বলা শুরু করেন, ‘লাইলির যখন মা চলে যায় তখন তার বয়স আট।’
‘আট কেন? ‘ভদ্রলোকটি কে ছিলেন? ‘আপনি আগে টের পাননি? ‘অবশ্য এগুলো আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার (যেন ব্যক্তিগতর বাইরে কোনো ব্যাপার রয়ে গেছে।)।’’’’
ফলে মৃত্যুচিন্তা করেন এমন কাউকে নিয়ে গল্প লেখা কঠিন। আমরা ঘুরে-ফিরে লাইলির কাছেই ফিরে আসি। আর এইমাত্র, গতকাল, লাইলি ফোন করে জানিয়েছে যে তার বাবা মারা গেছেন, আমরা যেন তাকে দেখতে যাই।
১৯৯৩