১৯৮৯ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখ শনিবার দুপুর বেলায় আমি নিউ মার্কেট থিকা একটা ড্রয়িং খাতা কিনছিলাম।
গবেষকদের মতন যে তারিখ কইতে পারলাম সেইটা নাজিব তারেকের কৃপা।
আমি ড্রয়িং খাতা লইয়া হাঁইটা যাইতে ছিলাম শাহবাগে। জাদুঘরের সামনে আর্ট কলেজের তৎকালীন ছাত্র নাজিব তারেক-এর লগে দেখা হইল। উনি আমার খাতা নিয়া প্রথম পাতায় একটা ছবি আইঁকা দিলেন ঝট কইরা। বিরক্ত হইছিলাম। পরে বুঝছি আর্ট করতে পারেন যারা তাদের অনেকেরই এইটা একটা কর্তব্যবোধ। তো ওইদিন আমি টব আর কাপ লইয়া দুই পৃষ্ঠা ঘ্যাচঘুচ করলাম। ছবি আঁকন যে কঠিন কাম বুঝতে পাইরা অফ মাইরা গেছিলাম। পরের দিন এই ছবিটা আঁকি। ছবির নাম দিছিলাম ‘দি ম্যান উইথ দ্য মিরর’।
স্যুররিয়ালিজম ঘরানার ছবি। স্যুররিয়ালিজমরে তখন ঢং কইরা কইতাম সাররিয়ালিজম। এই ঘরানা আর্ট কলেজের বিদ্যার্থী এবং বিদ্যাদাতারা বিশেষ ভালো চোখে দেখেন না বইলা আমি তখন টের পাইছি। তৎপরে বয়সে বড় আর্টিস্টরা কইছে রাইসু, এগুলি পাশ্চাত্যের অনুকরণ। মাটি কই?
ওনাগো কথা শুইনা পরে মাটি-পানি এগুলিও আঁকছি ছবির মইধ্যে। আমার জীবন যাপন যেহেতু পাশ্চাত্যের অনুকরণে আমি সেই নিয়া বিব্রত হই নাই। যারা মাটি নিয়া ছবি আঁকছেন, দেখছি একবার ভারতের শান্তিনিকেতনের মাটি নিয়া আঁকছেন, জাপান-জার্মানি ঘুইরা আইসা ওই অঞ্চলের মাটি নিয়া আঁকছেন।
আর্ট কলেজে টিকতে না পারলে কী হইব ওই সময়ে অভিজিৎ (অভিজিৎ এখন শাহবাগ আজিজ মার্কেটে বস্ত্র ব্যবসা ‘তারা মার্কা’র স্বত্বাধিকারী। আমরা বাংলাবাজার পত্রিকায় এক লগে আছিলাম।), জুয়েল, টগর (পরের দুইজন এহন আর্ট কলেজের মাস্টার) এগো লগে দেখা করতে যাইতাম।
’৮৬ সালে নির্বাচনের সময় আমগো বাড্ডায় অনেক মারামারি হইতেছিল। আমি সেই সময় কিছুদিনের জন্য আর্ট কলেজের শাহনেওয়াজ হলে জুয়েলের কৃপায় থাকি।
ওইখানে ওর লগে কার্ড আঁকতাম। আমার হাতের লেখা সুন্দর আছিল বইলা ওই কার্ডের লগে আবার কবিতার লাইনও জুইড়া দিতাম। কার কার লাইন মনে নাই। আবুল হাসান বা হেলাল হাফিজের লাইন হওনের সম্ভাবনা বেশি। তো ওই কার্ড বেচতাম বইমেলায়। তারপরে ওই টাকা দিয়া ভাত খাইতাম।
একদিন জুয়েল টাইম মতন ভাত খাওনের টাকা না দেওয়ায় পরে কার্ড বেচনের শৌখিন ব্যবসা বন্ধ কইরা দেই।
বইমেলায় এর আগে আমি যাই নাই। আমি যেইখানে কার্ড বেচতাম তার পাশেই ছিল এক ফিলোসফারের স্টল। প্রেক্ষিত বইলা একটা ছোট কাগজ বেচতেন উনি। নাম মফিজুল হক (মফিজ ভাই বেঙ্গল চিত্রালয়ে আছেন। ওনার সন্ত্রাসের ব্যাকরণ বইলা একটা বই মাঝখানে মৃদু সাড়া জাগায়ছিল।)
ওনার লগে আলাপ-সালাপ করতাম। মেলা চক্কর দিতে গিয়া পরিচয় হইল কবি জাহিদ হায়দারের লগে। উনি কবিতার বই বেচতেছিলেন একটা টেবিল লইয়া। কইলেন শিল্প হইল একটা মাস্টারবেশন। ওই বয়সে এই রকম শুনতে বেশ আনন্দ লাগছে।
শিল্পচর্চার আনন্দ পরে ম্রিয়মাণ হইয়া গেছে। ওই বছরই ফরিদা হাফিজ এবং আদিত্য কবিরের লগে পরিচয় হয়। পরে সেইসব পরিচয় কালের অতল গহবরে দুই বছরের লাইগা হারাইয়াও যায়। শেষে আমি যখন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মৌলিক উৎকর্ষ কার্যক্রম বইলা এক বিদ্যাসভায় যোগ দেই তখন সবার লগে সহিভাবে পরিচয় হয়। আমি সাহিত্য ও শিল্পকলারে এর তৎকালীন মাতব্বরদের নিয়ন্ত্রণের জায়গা থিকা দেখতে অভ্যস্ত হই।
যাই হউক, আমি কথা কইতেছিলাম স্যুররিয়ালিজম লইয়া। স্যুররিয়ালিজম লইয়া সকলেই হাসে। কিন্তু স্যুররিয়ালিজম নামের আন্দোলনটি আর্টের যেই ঘরানাটারে দখল কইরা ভাবসম্প্রসারণ করছে সেই জিনিস সেই ভঙ্গি বহুকাল আগে থিকাই আছে। আপনেরা হিয়েরোনিমাস বস্চ্-এর (১৪৫০-১৫১৬) ছবি দেখতে পারেন। মনে হইতে পারে স্যুররিয়ালিস্ট ছবি। কিন্তু উনি অনেক আগেই আঁকছেন, এবং সেইটারে কোনো আন্দোলনে যুক্ত করেন নাই।
ছবি আঁকতে গেলে ইমেজের সমাজসম্মত বা রীতিসম্মত ধারণায় ব্যাতিচার ঘটে, সেই জিনিসরে স্যুররিয়ালিজম বইলা নির্দেশ করা সহজ। হয়তো এই দোষে আমার ছবি দুষ্ট। হউক গা!
পান্থপথ, ঢাকা ১০/২/২০০৬
(আমার শিল্পচর্চার খানিকিতিহাস ২)