রবীন্দ্রবিরোধীদের ভাত নাই অথবা ফররুখ আহমদের ‘কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি’

কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি

কাঁচড়া পাড়ায় রাত্রি। ডিপোতলে এঞ্জিন বিকল—
সুদীর্ঘ বিশ্রান্ত শ্বাস ফেলে জাগে ফাটা বয়লার,
—অবরুদ্ধ গতিবেগ। তারপর আসে মিস্ত্রিদল
গলানো ইস্পাত আনে, দৃঢ় অস্ত্র হানে বার বার।

জ্বলন্ত অগ্নির তাপে এই সব যন্ত্র জানোয়ার
দিন রাত্রি ঘোরে ফেরে সুদুর্গম দেশে, সমতলে
সমান্তর, রেলে রেলে, সেতুপথ পার হয়ে আর
অভীষ্ট লক্ষ্যের পানে দার্জিলিংয়ে আসামে জঙ্গলে।

আহত সন্ধ্যায় তারা অবশেষে কাঁচড়া পাড়াতে।
দূরে নাগরিক আশা জ্বলে বালবে লাল-নীল-পীত;
উজ্জীবিত কামনার অগ্নিমোহ-অশান্ত ক্ষুধাতে;
কাঁচড়া পাড়ার কলে মিস্ত্রিদের নারীর সঙ্গীত।

(হাতুড়িও লক্ষ্যভ্রষ্ট) ম্লান চাঁদ কৃষ্ণপক্ষ রাতে
কাঁচড়া পাড়ায় জাগে নারী আর স্বপ্নের ইঙ্গিত।

প্রথম প্রকাশ: সওগাত, ১৯৪১
সূত্র: হে বন্য স্বপ্নেরা (১৯৭৬), ফররুখ আহমদ; সম্পাদনা : জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী [ফররুখ আহমদের মৃত্যুর দুই বছর পরে প্রকাশিত]

farrukh 8
(ফররুখ আহমদ, জন্ম: মাঝআইল, যশোর ১০/৬/১৯১৮; মৃত্যু: ইস্কাটন গার্ডেন, ঢাকা ১৯/১০/১৯৭৪)

ফররুখ আহমদ ১৯৪৫ সালে রচিত ও মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত ‘উর্দ্দু বনাম বাংলা’ কবিতায় লিখতেছেন:

দুই শো পঁচিশ মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেতন
বাংলাকে তালাক দিয়া উর্দ্দুকেই করিয়াছি নিকা
বাপান্ত শ্রমের ফলে উড়েছে আশার চামচিকা
উর্দ্দু নীল আভিজাত্য (জানে তা নিকট বন্ধুগণ)।
আতরাফ রক্তের গন্ধে দেখি আজ কে করে বমন?
খাঁটি শরাফতি নিতে ধরিয়াছি যে অজানা বুলি
তার দাপে চমকাবে এক সাথে বেয়ারা ও কুলি
সঠিক পশ্চিমী ধাঁচে যে মুহূর্তে করিব তর্জন।

পূর্ণ মোগলাই ভাব, তার সাথে দু’পুরুষ পরে
বাবরের বংশ দাবী—(জানি তা অবশ্য সুকঠিন
কিন্তু কোন লাভ বলো হাল ছেড়ে দিলে এ প্রহরে)
আমার আবাদী গন্ধ নাকে পায় আজো অর্বাচীন
পূর্বোক্ত তালাক সূত্রে শরাফতি করিব অর্জন;
নবাবী রক্তের ঝাঁজ আশা করি পাবে পুত্রগণ।

ফররুখ আহমদ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পরই সওগাত পত্রিকায় ‘পাকিস্তান: রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ নিবন্ধে লেখেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে, এ নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আলোচনা হয়েছে। জনগণ ও ছাত্রসমাজ অকুণ্ঠভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং, এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে, পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে। যদি তা-ই হয়; তবে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।”

মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ এবং আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত ফররুখ-রচনাবলী প্রথম খণ্ড-তে [আহমদ পাবলিশিং হাউস, অক্টোবর ১৯৭৯] কবি জীবনী অংশে দেখা যায়:

ফররুখ আহমদের জীবনে দারিদ্র ও দুঃখ দুর্দশা বিশেষ ভাবে নেমে আসে ১৯৭১ সালের পর। তিনি সাবেক পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন, তিনি পাকিস্তানীমনা ও তমদ্দুনের কবি—এমনি ধরনের অলিখিত অভিযোগ তোলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। একটি দৈনিক পত্রিকায় তাঁকে আক্রমণ করে দু’একটি প্রবন্ধও লেখেন জনৈক বিশিষ্ট সাহিত্যিক। বস্তুতঃ, এসব কারণে সে-সময় ফররুখ আহমদের বেতারের চাকুরি অনিশ্চিত হয়ে ওঠে, বেতন বন্ধ হয়, তিনি হয়ে পড়েন বেকার। এ-সময় আহমদ ছফা দৈনিক ‘গণকণ্ঠে’ ‘কবি ফররুখ আহমদের কি অপরাধ?’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে ফররুখ আহমদের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগসমূহের দাঁত-ভাঙা জবাব দেন, এবং এসবের অসারতা বিশ্লেষণ করেন। বেকার কবি ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের দুঃখ-দুর্দশার বিবরণ দিয়ে তিনি লেখেন :

খবর পেয়েছি বিনা চিকিৎসায় কবি ফররুখ আহমদের মেয়ে মারা গেছে। এই প্রতিভাধর কবি—যাঁর দানে আমাদের সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে—পয়সার অভাবে তাঁর মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে পারেন নি, ঔষুধ কিনতে পারেননি। কবি এখন বেকার। তাঁর মৃত মেয়ের জামাই, যিনি এখন কবির সঙ্গে থাকছেন বলে খবর পেয়েছি, তাঁরও চাকুরি নেই। মেয়ে তো মারাই গেছে। যাঁরা বেঁচে আছেন, কি অভাবে, কোন অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিনগুলো অতিবাহিত করছেন, সে-খবর আমরা কেউ রাখিনি। হয়তো একদিন সংবাদ পাবো না খেতে পেয়ে বৃদ্ধ কবি মারা গেছেন অথবা আত্মহত্যা করেছেন।

farrukh 11
ঢাকা বেতারের একটি কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে (বাম থেকে) : কবি আহসান হাবীব, কবি ফররুখ আহমদ, কবি আবুল হোসেন, কবি বেগম সুফিয়া কামাল, কবি শামসুর রাহমান ও কবি আবদুল কাদির

ফররুখ আহমদের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগ সমূহের দাঁত ভাঙা জবাব এইটা হইল কিনা জানি না। হয়তো ঐ লেখার সবটা পড়তে পারলে বোঝা যাইত। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে অনাহারে অর্ধাহারে বিনা চিকিৎসায় মারা যান ফররুখ আহমদ।

ফররুখ আহমদের জীবনে ইসলামী ভাবধারা আসছে (উনি নাকি আগে বামপন্থী এবং বিপ্লবী এম এন রায়ের তরিকপন্থী ছিলেন) হইল গিয়া তৎকালীন যুগের ইসলামী বিষয়ে সুপণ্ডিত ও ইংরেজি ও আরবীতে এম-এ ফার্স্ট ক্লাশ অধ্যাপক আবদুল খালেকের কল্যাণে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চতুরা-নিবাসী আবদুল খালেকের সঙ্গে ফররুখ আহমদ তিন দিনের একটা যুক্তিতর্কে গেছিলেন। পরে ফাইটে হাইরা গিয়া ইসলামী জীবনাদর্শে ঈমান আনেন। এর রেজাল্ট হিসাবে তার সিরাজাম মুনীরার কবিতাগুলা লেখা হয়। এবং বইটা তিনি তার ‘পীর’ ‘আলহাজ্জ মৌলানা আবদুল খালেক সাহেবের দস্ত মুবারকে’ উৎসর্গ করেন।

বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭; এর বিক্রয় বন্ধ আছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মার্চ ২৬/২৭ বিতর্ক শোধরাইয়া নাকি বাজারে আসবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে আরেক প্রস্থ এটির বিপণন বন্ধ থাকবে আশা করা যায়।) বলতেছেন, ফররুখ আহমদ “পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আদর্শের প্রতি অবিচল বিশ্বাস স্থাপন” করছিলেন। “রবীন্দ্র-সঙ্গীত পাকিস্তানের আদর্শের পরিপন্থী এই বক্তব্য উপস্থাপন করে ১৯৬৭-র ২২ জুন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন জাতীয় পরিষদে এক বিবৃতিতে রেডিও ও টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্র-সঙ্গীত প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে মন্ত্রীর সেই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন” করছিলেন তিনি।

হায় সমর্থন! রবীন্দ্র-বিরোধিতা করতে গিয়া অভাবে-দুর্দশায় মরতে হইল ‘ইসলামী ভাবাদর্শের’ এই কবিরে। রবীন্দ্র-ভক্তরা মাফ না করলেও রবীন্দ্রনাথের মত দরদী কবি নিশ্চয়ই এই অনুজ স্বার্থপর কবিরে চাকরিতে বহাল রাখতেন। আফটার অল না খাইয়া মরতে দিতেন না। অবশ্য ১৯৭৪ সালে কবি-না বা পাকিস্তানপন্থী-না বা রবীন্দ্রবিরোধী-না এই রকম অনেক লোকও না খাইয়া মরছেন। সেইটাও চাইলে মনে রাখন যায়।

ওনার মৃত্যুর পরে কবি শামসুর রাহমান জানাইতেছেন, “তিনি মারা গেছেন একেবারে নিঃস্ব অবস্থায়।… তাঁর মতো অসামান্য কবি খুবই সামান্য একটা চাকুরি করতেন।” জসীম উদদীন লেখতেছেন, “ঐ পাগলার জীবনে এমন আশ্চর্য ঘটনা আছে। ইউনেসকো থেকে তাকে স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছিল। বছর খানেক বিদেশের সাহিত্যিকদের সঙ্গে মিলতে মিশতে। কিন্তু পাগলা গেল না।”

বোঝা যাইতে পারে, অনাহারের কালে অন্য কবিরা তার খবর নেন নাই।

ঢাকা ৯/৩/২০০৬

 

Leave a Reply