ব্রাত্য রাইসু কেমন নাম

১.
এইটা আমার নিজের রাখা নিজের নাম।

আমার জন্ম পরবর্তী নাম ছিল ‘রইছউদ্দিন মোহাম্মদ আবুল খায়ের ঢালী”। আমার জন্ম ঢাকার বাড্ডায়, ১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাসের ১৯ তারিখে। শনিবার দিবাগত রাত্রিতে, সে অনুসারে রবিবারে। যতদূর শুনছিলাম মনে পড়ে, কোনো পীর আমার এই নাম রাইখা দিছিলেন।

ছোটকাল থিকাই নানা নিক নামের মধ্য দিয়া আগাইতে হইছে আমার, তাই এই নাম তেমন কানে শুনি নাই।

২.
আমার চুল প্রায় অর্ধেক পাইকা গেছিল ক্লাস ফোরের সময়। তখন পাড়ার ছেলেরা আমাকে ডাকত ‘চুল পাকনা’। এছাড়াও নাম ছিল ‘সাদাকালো’, ‘হাফ লেডিস’, ‘পেজগি’, ‘কিসিন্জার’ ইত্যাদি।

ছফা ভাই আমাকে ডাকতেন ‘রাইসু কোম্পানি’। তখন আমি প্রেমে পড়ছিলাম ও অল্পদিন প্রেম করছিলাম একটা মেয়ের সঙ্গে, ১৯৯৫-এ, দ্বিতীয় প্রেম, তার নাম ছিল অন্বেষা। ছফা ভাই তাকে ডাকতেন ‘অন্বেষা কোম্পানি’ বইলা। সে আমলে ছফা ভাইয়ের দুই কোম্পানি ছিলাম আমরা।

সে বছর রোজার ঈদের দিনে দুপুরবেলা তাকে ছফা ভাইয়ের বাসায় প্রথম আমি দেখি। দিনাজপুর থিকা পলাইয়া চইলা আসছিল অন্বেষা। সম্ভবত নাচ শিখতে চাওয়া সংক্রান্ত কোনো ব্যাপার ছিল পরিবারের সঙ্গে।

অন্বেষার কথা অনুসারে ছফা ভাইও অন্বেষার প্রেমে পড়ছিলেন। ওই টাইমটায় অন্বেষার কারণে ছফা ভাইয়ের বাসায় তরুণ লেখক কবি বুদ্ধিজীবীদের ভিড় লাইগা যাইত। অন্বেষার ছফা ভাইয়ের প্রেমে পড়া সংক্রান্ত কথাটা আমি পুরাই বিশ্বাস করি।

কিছুদিন পরে অন্বেষা ছফা ভাইয়ের বাসা ছাইড়া দেন। ওঠেন আমার তখনকার বন্ধু লীসা অতন্দ্রিলার বাসায়।

অন্বেষা শুনছি লন্ডনে তার নাচের স্কুল খুলছেন ‘অন্বেষা কোম্পানি’ নামে।

৩.
স্কুলে সংক্ষেপে পরীক্ষায় খাতায় লিখতাম ‘রঃ মোঃ আবুল খায়ের ঢালী’। আমি পড়তাম খিলগাঁও গভমেন্ট হাই স্কুলে। স্কুলে আমাকে ‘ঢালী’ নামেও ডাকত অনেকে।

আমার সেই লম্বা নাম, বা বিসর্গ সমৃদ্ধ ও পদবীযুক্ত নাম কখনো পছন্দ ছিল না।

পরে আমি লেখালেখি ছাপানোর কালে নিজের নাম বদলাইয়া প্রথমে ‘রইসউদ্দিন রাইসু’ ও আরো পরে ‘র. রাইসু’ করি।

৪.
আমার মনে আছে আমি কবি ও ‘শিল্পতরু’ সাহিত্য পত্রের সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ ভাইকে কবিতা দিতে গেছিলাম ওনার বাড়িতে, গ্রিন রোডে, ১৯৮৮ সালে। দেখি উনি বাড়িতে নাই। আমাকে বাড়ি থেকে ওনার অফিসের ঠিকানা দিলেন বোধহয় ওনার আব্বা বা অন্য কেউ, এতদিন পরে আর মনে নাই।

আমি মান্নান ভাইয়ের এলিফেন্ট রোডের একটা অফিসে গিয়া দরজায় নক করলাম। নিচ তলায় বড় একটা রুমে অফিস। ভিতরের দূর থিকা তার তীক্ষ্ন তোলা অভিজাত গলায় মান্নান ভাই চিৎকার কইরা জিজ্ঞেস করছিলেন “কী চাস?”

‘তোলা গলা’ নিয়া আরেকটা গল্প মনে পড়ল। বইলা নেই, পরে মান্নান ভাইয়ে যাব।

ওইটা হক ভাইয়ের মানে সৈয়দ শামসুল হক ভাইয়ের প্রসঙ্গ। গল্পটা বলছিলেন সাজ্জাদ (শরিফ) ভাই।

যে, ভাবি (আনোয়ারা সৈয়দ হক) নাকি কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, তোমাদের হক ভাই কিন্তু ঘরে এই ভাষায় কথা বলে না। এটা তোমাদের জন্যে ওঁর তোলা ভাষা। সাজ্জাদ ভাই বলতে পারবেন ঠিক কী বলছিলেন।

তো মান্নান ভাইকে দেখা গেল দূরে খালি বড় একটা কক্ষের দূরতর প্রান্তে বিশাল টেবিলে মাথা নিচু করে কলম হাতে কাগজে বসে আছেন। আমি বললাম, “কবিতা আনছিলাম।”

উনি কাগজ থিকা মাথা ওঠাইলেন। একবার দেখলেন, বললেন, “ভেতরে আসো।”

আমি স্পন্জের স্যান্ডেল পরি তখন। তার শব্দ তার খালি অফিসে চ্যাটাং চ্যাটাং আওয়াজ করতেছিল। আমি কবিতা হাতে সম্পাদক মান্নান ভাইয়ের টেবিলের সামনে গিয়া পৌঁছলাম।

তিনি কবিতা দেখতে চাইলেন। আমি সঙ্গে নিয়া যাওয়া পাঁচটা কবিতা তার হাতে দিলাম। উনি বললেন, “বসুন।”

আমি বসলাম।

৫.
মান্নান ভাই দুইটা কবিতা রাখলেন। বললেন, “এ দুটো রাখলাম, আমাদের পত্রিকা অফিস চেনেন তো?”

আমি ওনারে বললাম যে সেখান থেকেই তার বাসার ঠিকানা নিছি। এবং বাসা থিকা যে তার অফিসের ঠিকানায় আসছি।

উনি বললেন, “আর কখনো বাসায় যাবেন না।”

এরপর বললেন, প্রয়োজনে শিল্পতরু অফিসে যাইতে। এবং সে বছর অক্টোবর মাসের কত তারিখে কবিতা ছাপা হবে কোনদিন, আমি যেন পত্রিকা অফিস থেকে আমার কপি সংগ্রহ করি।

৬.
পরে আমি আমার বন্ধু পিকাসো সহকারে ওনাদের (মনে হয় অফিসটা ছিল কবি আবিদ আজাদের) কাঁঠাল বাগান ঢালের ‘শিল্পতরু’ অফিস থেকে পত্রিকার কপি সংগ্রহ করি।

উনি আরো কবিতা চাইছিলেন। আমি পরে সেই কবিতা নিয়া যখন যাই ও আমার নাম হিসাবে ‘রইসউদ্দিন’-এর বদলে ‘র রাইসু’ প্রস্তাব করি, উনি তাতে রাজি হন নাই। আমি আর ওনারে কবিতা দেই নাই। খেলা শেষ।

পরে ওনার বাসায় অনেক গেছি। দাওয়াত দিয়া খাওয়াইতেন। মৃত্যুর আগে কী কারণে জানি না আমাকে আর পাত্তা দিতেন না। মাঝখানেও একবার এই রকম করছিলেন।

সাহিত্য করা লোকজন কান ভারি করে এই রকম। শুনছি। আর সাহিত্য করা লোকজন অন্যের কথায় কানও বেশ দেয়। একদমই পাড়ার ঝগড়াঝাটির মতই এইগুলা।

৭.
এরপর তাজুল হকের নদী পত্রিকা কাম লিটল ম্যাগে র. রাইসু নামে আমার কবিতা ছাপা হয়।

এরপর আমি ‘ব্রাত্য রাইসু’ নাম নির্ধারণ করি নিজের জন্যে। ও সেই নামেই কবিতা লেখালেখি, পাসপোর্ট করাকরিসহ সকল কার্যক্রম করে আসছি।

আমার বাসার লোকেরা আমার এই নতুন নাম নিয়া তাদের প্রতিক্রিয়া দেখান নাই কখনো।

আমার নানি চিটাগাংয়ে একটা স্কুলে পড়াইতেন, তার চারটা বই বের হইছিল। আমি তারে জীবিত দেখি নাই। বইয়ের কথাও জানছি এই সেই দিন আম্মার কাছ থিকা। সুতার কাজ বা নকশা বিষয়ক বই। নাকি সাহিত্য বিষয়ে নিশ্চিত না আম্মা। আমার খালুর বাসায় নাকি ছিল অনেক দিন বইগুলি। পরে অদৃশ্য হইছে সব বই।

আম্মা ‘বেগম’ পত্রিকায় গল্প লিখছেন বোধহয় ১৯৬৪-তে। পরে সেই গল্প এবং গল্পের সঙ্গে আম্মার সেই আমলের ছবি দেখছিলাম, তাও সে কোন শৈশবে। পত্রিকাটা হারায় গেছে। লেখালেখির একটা চর্চা থাকার কারণেই হয়তো আমার নাম ভাঁড়ানো বা নতুন নাম নেওয়া নিয়া তাদের আপত্তি ওঠে নাই কোনোদিন।

এমনিতে অতি ছোটকালে আব্বা যখন মাসুদ রানা পড়তেন, আমি আব্বার পাশে শুইয়া শুইয়া সে বই পড়তাম। আর আম্মার কাছ থিকাই প্রথমে আমি ইউএফও বা ফ্লাইং সসারের কথা শুনি।

আম্মা ইত্তেফাক আর সংবাদ পইড়া এইসব জানতেন ও বলতেন। ‘গাছপাথর’ ছিলেন তখনকার কলামিস্ট, আম্মার পছন্দের। কোনো লোকের নাম কেন গাছপাথর শৈশবে তা বেশ চিত্তচাঞ্চল্য জাগাইত।

৮.
আমার বই পড়া সংক্রান্ত যাবতীয় ঋণ আমার আব্বা ও আম্মার কাছে। আমাদের এক আত্মীয় ছিলেন, তার বইয়ের দোকান ছিল নিউ মার্কেটে, মোকাররম। এখনও আছে। উনি ছোটকালে বেড়াইতে আসলে বই নিয়া আসতেন। পরের বার আগের বারের বই ফেরত নিয়া নতুন বই দিয়া যাইতেন।

ওই অতি ছোটকালে আমি ‘বাঙালীর হাসির গল্প’, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘পাতাবাহার’ পত্রিকা ইত্যাদি পইড়া সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হইছি। মনে আছে সে সময় পাতাবাহারে সরদার জয়েনউদ্দিনের ‘সোনালী মেষলোম’ কিশোর উপন্যাসটা পইড়া খুব চমকিত হইছিলাম।

আমার সেই আত্মীয়কে বলছিলাম, ‘আরব্য উপন্যাস’ নিয়া আসতে। কিন্তু উনি এইটা বড়দের বই বইলা আনেন নাই। আমি পরে বড় হইয়া ক্লাস এইটে উইঠা সেই বই পড়ি। সেই বছরই ‘রোববার’ পত্রিকায় গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘শতর্বষের নিরবতার’ অনুবাদ বা কোনো ফিচার পইড়া আমার সাহিত্যিক জীবনে পরিণতি নাইমা আসে।

আমি অবশ্য তারও অনেক আগে সিদ্ধান্ত নিছিলাম যে বড় হইয়া আমি লেখক হব। নিজের নাম নিজে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত পরিপক্ক হইতে অবশ্য আমার আরো অনেক টাইম লাগছে।

৯.
কিন্তু আমার এই নাম নিয়া হালের ও অতীতের বহু লোকের বেকা হাসির ইতিহাস আছে।

আমি কেন নিজ নাম নিজে রাখলাম এই নিয়া অনেক পিতৃতান্ত্রিকদের গোয়া জ্বলে।

জ্বলবার কারণ নাই। আপনারা বাপের দেওয়া নাম বহন করতে থাকেন।

৪/১০/২০১৬

Leave a Reply