ভড়ং সর্বস্ব বাংলা আর্ট অ্যান্ড কালচারের হিসাব গুলিয়ে দেওয়ার ম্যাজিকের নাম ব্রাত্য রাইসু

এবং হে পাঠক, রাইসুর স্তুতিমুখরতায় নিজেরে ভাসানোর তরে আমার এ গদ্য নহে। বলে রাখা ভালো, কবি, চিত্রকর ও চিন্তাবিদ ব্রাত্য রাইসু আমার ব্যক্তিগত বা অব্যক্তিগত, কোনো প্রকার বন্ধু নয়। আর তা নয় বলেই রাইসুকে নিয়ে নিজের দু’চার কথা আমি লিখে ফেলছি, তাঁর জন্মদিনের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে।

প্রথমেই এসব বলতে হোলো, কারণ, বাংলা কবিতা বা বাংলা সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির দৃশ্যমান প্রেক্ষিত বড় বেশি মিডিয়ার পয়দা করা আচরণবিধিতে গ্যাদগ্যাদে, কিংবা বলা ভালো মিডিয়ার পয়দা করা মিডিওকারদের এইসব বেঙ্গলি আর্ট অ্যান্ড কালচার মিডিওকার হ্যা-হ্যা ফ্যা-ফ্যা, গা-ঘষাঘষি ও পারস্পরিক সুড়সুড়ি নির্ভর! কিন্তু এই সুড়সুড়ি জগতের লোক রাইসু নন। রাইসু চাকরজীবী বা মঞ্চজীবী বা কবিসভাজীবী কবি বা বুদ্ধিজীবী নন যেহেতু, যেহেতু রাইসুই ‘অখণ্ড বাংলা’য় হাতে গোণা কয়েকজন স্বাধীনচেতা ও আত্মযাপনে মগ্ন লেখক, কবি, চিন্তাবিদ তাই তাঁকে নিয়ে লেখা ছাড়া উপায় নাই।  এবং তাঁর ও আমার দূরত্ব অনেক অনেক, তাই তাঁকে নিয়ে লেখা সেফ। মানে, আমি হাওড়ার কবিতালিখিয়ে, আমি যেমন ইচ্ছা তেমন অতনু সিংহ, এই ব্রাত্য রাইসুর পঞ্চাশ বছরে না লিখলে, আর কে লিখবে? এই ভাবনা থেকেই লেখা। চিয়ার্স ম্যান, রাইসু, আপ্নারে শুভেচ্ছা।

অতনু সিংহ

আমি কবিতা লিখি মূলত। কবিতা ছাড়া বাকি যা লিখি, তার কিছু কবিতার মতো আর বাকিসব হাবিজাবি, না লিখলেও চলে। তো আমি কবি ব্রাত্য রাইসুকে চিনি বহুদিন। রাইসুকে চিনি আমার বিগত এক বান্ধবীর সূত্রে ( যিনি পশ্চিমবঙ্গের এক কবি)! ২০০৯ সালের মে মাসে একদিন রাতে টেলিফোনে আলাপের সময় একদিন রাইসুর কবিতা পড়ে শোনান। এবং রাইসুর প্রতি তাঁর প্রণয়বোধের কথা জানান। তাঁদের অর্কূটে স্ক্র্যাপ বিনিময় ও চ্যাটের বিষয়েও তিনি বলেন। সেই রাইসুকে আমার চেনা শুরু।

শুরুতেই রাইসুর কবিতা আমার ভালো লাগে। তাঁর মারফৎ আমি রাইসুর উচ্চারণের সহিত পরিচিত হই। ক্রমে তাঁর কবিতার প্রতি আমার আগ্রহ ও  ভালো লাগা বেশ জমাটি আকার পায়। কিন্তু আমার বান্ধবীর লগে তাঁর চ্যাট আমার মোটেও ভালো লাগেনি, মানে আমি তখন ওইপ্রকার আনস্মার্ট এবং পোজেসিভ ছিলাম, আমি ওই মেয়েটিকে, মানে আমার বান্ধবী কবিকে,  মুখে কিছু না বললেও ব্যাপারটায় বেশ… থাক সেসব… এরপর ওই বছরেই কবি উৎপল (উৎপলকুমার বসু) আমায় দেওয়া তাঁর এক সাক্ষাৎকারে তাঁর ভালো লাগা নব্বই দশকে দুই বাংলার বেশ কয়েকজন কবির কথা বলেন। সেই তালিকায় রাইসু ছিলেন। সেই তালিকায় আমার অপছন্দের অনেক কবি থাকলেও, ব্রাত্য রাইসু ও আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে আমি ও উৎপলদা সহমত ছিলাম।

রাইসুকে আমি তাঁর লেখা দিয়েই দেখেছি। ব্যক্তি রাইসুর সাথে আমার ইনবক্সে দুই-তিন লাইনের বেশি কথা হয় নাই। হয় নাই ফোনালাপ, মুখোমুখি সাক্ষাৎ, চা কিংবা মদ্যপান, বরং ফেসবুকের কমেন্টে কথাকাটাকাটি হয়েছে, আমার সমালোচনা ও আমার বিরুদ্ধে ওনার প্রতি-আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, আমায় ব্লক করেছেন, পরে তা খুলেওছেন, কিন্তু নো বাক্যালাপ… তাই দিয়ে ওনার কবিতা, লেখালিখি বা চিন্তাজগতের মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে আমি কোনো কুণ্ঠাবোধ করছি না। কেননা, কবিতা, শিল্প, সাহিত্যের ক্ষেত্রে দুই বাংলায় যে কয়জন আমার তাৎক্ষণিক পূর্বসূরী ও সমসাময়িকদের কবিতা, গদ্য, বা শিল্প বা নন্দনচিন্তার সঙ্গে আমি নিজেকে রিল্যেট করতে পারি তার মধ্যে ঢাকার ব্রাত্য রাইসু একজন।

পশ্চিমবঙ্গে শূন্য দশকে অর্থাৎ ২০০০-২০১০ এই সময়কালে আমার লেখালিখির শুরুর দিকের অনেকটা। মূলত কবিতা লিখতে লিখতে  আমার আগের দশকের যে কয়জন কবির কবিতায় আকৃষ্ট হয়েছি, রাইসু তার মধ্যে অন্যতম। এর কারণ, রাইসুর লেখায় পূর্বনির্ধারণ নাই, রাইসুর লেখায় আরোপিত গাম্ভীর্য নাই, রূপক ও অলঙ্কারের লাচালাচি লাই, আছে মুহূর্ত, মুহূর্তের ইমেজ, আছে সমুদ্র সীমারেখা ভেঙে দেওয়ার চারকোলের বিনির্মিত অক্ষর জ্যামিতি (তাঁর চিত্রশিল্পের মতোই), যে কারণে আমার উৎপলকুমারের ‘টুসু আমার চিন্তামণি’ ভালো লাগে, সে কারণেই আমি মাঝেমধ্যে চুপচাপ পড়ে ফেলি জনাব শ্রী ব্রাত্য রাইসুর কবিতা।

‘দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে’ যেভাবে কু কু করে আর পেয়ারা গাছের পাতা ঝরে যায়, সেইভাবে বাংলা কবিতায় ব্রাহ্মবাদীদের উপনিষদীয় গাম্ভীর্য আর কর্পোরেট গা-চুল্কাচুল্কির সামনে রাইসু লিখে যান তাঁর বাক্য, তাঁর কবিতার লাইন ঢিল হয়ে টোকা মারে বাংলা কবিতার ক্যালকুত্তা-গেজের কাচে, অথবা বঙ্গ-একাডেমির বঙ্কিমীয় সুজলাং-সুফলাং মলয়জ শীতাতপ আরামের সামনে এক পশলা অনির্ধারিত অন্তর্বাস্তবতাকে হাজির করেন রাইসু। কেননা, আর্ট অ্যান্ড কালচারের নামে এইসব সুরভিত ক্যালকাটা ও ঢাকা ক্লাব থেকে খল বল করে কীভাবে বেরিয়ে পড়ে রাষ্ট্রীয় দাঁত, যে দাঁত এগিয়ে যায় রামপালে, যে দাঁত থেকে পোশাকে ঝরে পড়ে রক্ত, আর রাইসু গুনগুন করে লিখে রাখেন—

তোমার দাঁতগুলিরে নদীর তীরে
ধুইতে নিয়ো
তোমার রক্তমাখা দাঁতগুলিরে
নদীর তীরে ধুইতে নিয়ো

তোমার শিশুর রক্তে মাখা
দিনগুলি যায়
বেতন ছাড়াই

তোমার শিশুর রক্তে মাখা
বসন তুমি ধুইতে নিয়ো
নদীর তীরে

তোমার শিশুর রক্তে রাঙা
তোমার দাঁতগুলিরে
নদীর তীরে
ধুইতে নিয়ো

(‘তোমার দাঁতগুলিরে’, ব্রাত্য রাইসু )

 

রাইসুর বাক্যের মধ্যে অন্তর্লিরিক খেলা করে কিন্তু আমার মতে তা লিরিকের বঙ্গীয় ইয়্যুরোপ চেতনা নয় বরং এই চরাচর বাংলার লোকগাথা, বাংলার ন্যারেটোলজির নানা প্রকরণ ও তার জৈব উপাদানগুলি আমাদের কৃষিসমাজের যে সমষ্টিগত নির্জ্ঞানকে ধারণ করে, বাংলার সেই নির্জ্ঞানই মাঝে মধ্যে সুর হয়ে বয়ে যায় রাইসুর বাক্যের শিরা-ধমনী বেয়ে।

এইখানে রাইসুর একটা কবিতা পাঠ করা যাক:

যে সব উদ্বাস্তু সঙ্গে প্রেম ছিল
ভাবের বাণিজ্য গুরুতর
তারা আজ
অন্য কারো প্রতি মজি
দুর্দান্ত প্রণয়ে উচ্চতর; কাহ্নুগীতি
প্রাহ্নানন্দে গায়

১.
স্থগিত। তোমার দৃষ্টি। অন্তরীণ ।
খোলো চোখ
দেখো যত স্বপ্নের চরিত্র
রয়েছে তোমাকে ঘিরে—পাঠ করছে—অবান্তর
শয্যার বর্ণনা

২.
শোনো আজ এই ভ্রম প্রস্তাবিত,
কুণ্ঠায় রচিত
ছিল, আমাদের প্রেম মাত্র ভাষা ব্যবহারে
ছিল তোমার উদ্ভাস
ভ্রান্তিময়;
একথা সংশয়ে বলি ক্লান্তিকর লৌকিক ভাষায়

৩.
এই যে পথের পার্শ্বে
যাদের চরণচিহ্ন—
অনর্থক ভাষার মারপ্যাঁচ;
স্তব্ধ হোক। তুমি চোখ তোলো।
দেখি, কোথায় অযথা বাক্য
থেমে যায়;
অবলীলাক্রমে

৪.
ধরো এই হাত আমি
অন্ধের জ্যেষ্ঠভ্রাতা
হেঁটে যায়, আগাছার সাথে কার
সম্পর্ক তেমন?
যাহা তোমার প্রশ্রয়ে হই
প্রগল্‌ভ;
—সহনশীলতা! তব সঙ্গে লহ,
অগ্র হও, না করো পশ্চাৎ


ওগো ছলোছলো চক্ষু
স্নেহপসারিণী—
ওগো প্রণয়সম্ভব করো প্রতারণাযোগ্য তুমি
না রাখো সংশয়;
আমি যথাবাক্যস্থলে,
তোমার বন্দনা করব, উদ্বৃত্ত কথায়

৬.
না করো করুণা শোনো স্থিরজলে আর্তপ্রতিকৃতি
পক্ষপাতে ভেসে যায়…
করুণা তোমাকে করে; না ভাঙে
হঠাৎ বায়ু-প্ররোচনা শুনে
চোখ রাখে সন্দিহান তোমার নয়নে;
তোমার বিচ্যুতি করো! পা রাখো অস্থির
দুই নৌকার গলুই-এ
যাহা বর্জ্য বেঁধে রাখো দুর্বল প্রতিমাপুঞ্জ, দীর্ঘ এপিটাফে।

৭.
বলো করো কেন কুণ্ঠা গুণ্ঠন লুটাও আধোলীনা।
যদি পথভ্রষ্ট তুমি
দষ্ট হও, ক্লেশ করো, অর্ধযতি হও!
স্বেচ্ছাচারে নত হও, পোড়াও অঞ্চল
তুমি পূর্ণরতি হও!
ও যার দ্বিধার মাত্রা হিমাংকেরও নিচে
তারে শুধাও কুশল
তারে জনসভা ডেকে
করো গো চুম্বন, তুমি হীনেগতি হও!

৮.
না হয় বিরহ বলো,
বলো তবে হৃদয় মধ্যাহ্ন
আমি তোমার যাতনা স্মরি
তব দুখবর্ষ আজি উদযাপন করি।

(‘প্ররোচনা’, ব্রাত্য রাইসু )

এবং যেহেতু এই নদী ও কৃষি সমাজের উত্তরমূখের প্রগতিতে রাইসুর যৌবনের দিনকালগুলি মেট্রো সিটি ঢাকাকে কেন্দ্র করে, তাই রাইসুর মধ্যে শহরও আসে সহজভাবেই, সহজ কেননা, কেননা তা আরোপিত বা পূর্বনির্ধারিত নয়। সহজ কেননা, তা বর্ষামঙ্গলের মতো জৈবিক।

আমরা ছয় তলাতে ফ্লাট
আমরা ঘরের মধ্যে নদী
আমরা নদীর মধ্যে বাউয়া ব্যাঙে
করছি চোদাচুদি

(‘আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি’ কাব্যগ্রন্থ, ব্রাত্য রাইসু)

হীনম্মন্য ও প্রিটেইনশাস মধ্যবিত্তদের ট্যাবু-পরিখা ভেদ করে ঢুকে গিয়ে কবিতার স্পর্ধা ওড়ান রাইসু, তাঁকে আগলে রাখে মায়ার স্তনযুগল, তাঁকে ভরসা দেয় স্তনের জৈবমহিমা। অবেচতনের চোদনামিকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে মন্দিরগ্রাত্রে খোদাই স্তন ও নাভির সমস্ত উপাদানকে বাক্যের ভিতরে নিয়ে এসে মুহূর্তের যৌনতাকে মিথিক্যাল আকার দিয়ে ফেলেন ব্রাত্য রাইসু। জৈব অনুভূতি, জৈব ও যৌন-নন্দনের কোনো টেলিভিশন নাই, সভা-সমিতি-আকাদেমিয়া নাই, কর্পোরেট স্পনসর নাই, বেবিফুড বিজ্ঞাপন নাই, বিলবোর্ড নাই, আছে অনন্তের দশমহাবিদ্যা, আছে নব-নব ডায়ামেনশন, আবিষ্কারের নেশা…

পড়া যাক:

স্তন । এই নারীবাক্য অধিক বিশেষ্য। মহাপ্রাণ ধ্বনিতে নির্মিত মাত্রা -জ্ঞান -শূন্য গোলক। অদৃশ্য বলয়যুক্ত যাদুঘর। ক্রমস্ফীতি। মেটাফিজিক্স। গোলক–যা বর্তুল, প্রাণময় । এই স্তন ধর্মসংক্রান্ত।

প্রিয় স্তন, খুলে বক্ষবন্ধনী আজ আব্রু রক্ষা করো ।

ঐ স্তন দ্যাখো লাফিয়ে উঠেছে শূন্যে — মহাশূন্য: বিপরীতে সামান্য শূন্যের। ওই ভীত শিশুদের জন্ম হচ্ছে যত্রতত্র –তারা গান গাইছে জ্যামিতির–করুণামিতির। হেসে উঠছে বর্তুলজাতক। কী যেন বাঁশির ডাকে জগতের প্রেমে, বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয়।

কেন এই স্তন বার বার! বাৎসল্যবিহীন যারা, লক্ষ করো, কীভাবে ব্যক্ত হয়ে উঠছে বাহুল্য; ওই ব্যক্তি হয়ে ওঠে স্তন–নারীবাদিনীর, ছুঁড়ে ফেলা ছিন্ন স্তন ফুঁসে উঠছে স্বীকৃতিসংক্রান্ত। তাকে দাও অধিকার– বিন্যস্ত হবার; তাকে শিশুদের হাত থেকে রক্ষা করা হোক!

ঐ স্তন ঘিরে ঘুরে আসছে মারাত্মক ভাবুক প্রজাতি। ভয়ে ও বিনয়ে, নুয়ে পড়ছেন অধ্যাপক–বিশুদ্ধ জ্যামিতি। ঐ স্তন ঘিরে উঠেছে সংক্রামক নগরসভ্যতা; ফেটে পড়ছে ত্রিকোণ-গোলক–

ঐ স্তন জেগে উঠেছে চূড়ান্ত —

ডাকো স্তন, হীনম্মন্যদের!

(স্তন, ‘আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি’ কাব্যগ্রন্থ, ব্রাত্য রাইসু)

হীনম্মন্যদের দিকে রাজনৈতিক আর্ট ও কালচারে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বসেন রাইসু। যে সকল হীনম্মন্য নবীন ও প্রবীন কবিরা ঘোরাফেরা করেন, সামলান পারস্পরিক হিসাবের জাব্দা খাতা, লেখেন ডেবিট-ক্রেডিট, আর সাঁতরায় আহাউহু কাব্যে। আর ইনবক্সে বলপ্রয়োগ বাক্যে জানতে চান শরীরের মাপ, পিতামহ কবিদের সেইসব নাতিপুতি কবিদের মাঝে রাইসু ঢুকে পড়েন আর ঘেঁটে দেন উহাদের সমাজবাস্তব, আর হিহি হিহি লিখে রাখেন:

দেখো বয়স্ক আর হাড্ডিশুখনা রামকবিদের দল
পরস্পরের পাখনা ধরে ঘোঁট পাকিয়ে পরস্পরে
রাজার ক্ষেতের পাড়ে
যেন উবে যাওয়ার আগমুহূর্তে
পায়ের পাতা শক্ত করল
মার্তৃগর্ভ ছেদন করল
তারপর তারা দাঁড়াল ভয়ঙ্কর।

যারা জায়গা পায় নি সামনাসামনি
রাজার চাইতে একটু বয়স কম
তারাও ক্ষেত ছাড়ে না
ক্ষেতের পাশেই একাডেমি
সেথায় সভার কাছেই
রাজার দিকে তাদের লম্বা হাত বাড়ানো
কাউয়া এসে বসেছে দীঘল হাতে—
তাদেরও আশা পূর্ণ হলো
রাজাটি যখন হাসিল উত্তরে।

আর ওই যে বাচ্চা কবির তরুণ ছবির করুণ দেখা পাওয়া—
তাও যাচ্ছে পাওয়া।
ওরাও, তেমন তরুণ যদিও নয়,
তবু বড় কবিদের লাগোয়া দল ওরা—
ওরা ছাপাই দঙ্গল—
ওরা নাতি কবি নাতনি কবি
আরো কবিদের সঙ্গে নিয়ে
ফুলের দণ্ডসম ওই তো ঝকমকাচ্ছে—
যেন ফুলের দলটি
কাকে দেবে আর কাকে দেবে না
নিজেদের ওরা ঠিক রাখতে পারছে না।

এরই মধ্যে
এদের মালিক যারা
ইন্ডিয়ারা
যেই,
বিমান থেকে নামিল ঢাকা ক্লাবে—
প্রথমে একজন পদ্মশ্রীই তো দৌড়ে গেলেন
তারপর গেল ফুলের দলটি
ততঃপরে মাঝারি কবি হেলতে দুলতে
বড় কবিরা রাজাটি সঙ্গে করে।

না, মহাভারত থেকে মোদীর সঙ্গে
পাইকার কোনো কবি আসে নি তাই
আপাতত তারা কুর্নিশিবেন ক্লাবে,
দেবেশ রায়ের দ্বারে।

(‘কবির দল’, ব্রাত্য রাইসু)

এভাবেই রাইসুর লিখে ফেলা কবিতা, এভাবেও ঠিক নয়, হয়তো ঢাকা শহরের চারিপাশে যেভাবে বিছায়ে আছে নদী, সেই নদীই হয়তো রাইসুর বাক্যে, রাইসুর বাংলা কবিতায়, সে নদীপথেই তিনি হয়তো গুরুসঙ্গ করেন অথবা করবেন বা করেছিলেন কোনোকালে অথবা সেই নৌকাতেই দেহের সাঁতার… তবে আপনারা নৌকাকে আওয়ামী লীগ ভাইবেন না ভায়েরা… কিংবা ধানের প্রসঙ্গ এলে প্লিজ জিয়াটিয়া নট…

বলে রাখা ভালো রাইসুর সঙ্গে আমি সমাজ-রাজনীতির নানা বিষয়েই সহমত নই। অবস্থান  আলাদা। কিন্তু ভাষা-রাজনীতির ক্ষেত্রে কিংবা ভাষার অন্তরালে পরিচিতিসত্তার যে কার্নিভালিয় লড়াই রয়েছে, তাহাতে আমি রাইসুর সঙ্গে নানা বিষয়েই সহমত। আবার কিছু ক্ষেত্রে নয়।

তাই আমরা বরং আসি রাইসুর সেই পরিচিত আলাপে, প্রমিত ভাষার সম্প্রসারণবাদের কথায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে কলকাতার লোক না হলেও কলকাতায় পড়াশুনা, সাহিত্য, ছাত্র রাজনীতি ও চাকরবৃত্তি করা লোক। যদিও আমার জন্ম ও প্রাথমিক-মাধ্যমিক পড়াশুনা হাওড়া জেলায়। আমি জানি, কলকাতার প্রমিত বাংলা ভাষা ইন্ডাস্ট্রি কীভাবে বাংলার ভাষাবৈচিত্র্য ও ভাষার সার্বভৌমত্বকে গ্রাস করে আসছে।  কবিতাসাহিত্যের ক্ষেত্রেও এটা সঠিক। কলকাতা ঠিক করে দেয় ঢাকার কারা কারা কবি। ঢাকার লোকেরাও কইলকাত্তাইয়া-খেলায় সাদরে অংশ নেন। এর নানা হিসেবনিকেশ আছে। কিন্তু প্রমিত ভাষা, ভাষার একমাত্রিক আবেদনের বিরুদ্ধে ব্রাত্য রাইসু ও তাঁর মতো কয়েকজনের নিরন্তর আলাপ কিছুটা হলেও প্রমিত ইন্ডাস্ট্রিকে থমকে দিয়েছে বলে আমি মনে করি। যদিও এক্ষেত্রে রাইসুর বিরুদ্ধে আমার তীব্র সমালোচনা, কলকাতার ভাষা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে গোটা পশ্চিমবঙ্গকে তিনি মিলিয়ে ফেলেছেন।

এমনটা আমার বহুবার মনে হয়েছে। আসলে কলকাতা যে একমাত্রিক ও একরৈখিক সাহিত্যের যে ভাষাগত উচ্চারণকে প্রোডিউস করে তা ততটা কলকাতার ভাষাও নয়। তা বাংলার দিল্লিমুখি কৃত্রিম এক বাংলা ভাষা। কেননা, পুরোনো কলকাতায় বা কলকাতার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সুতানাটি-গোবিন্দপুরের লিঙ্গ্যুইস্টিক কালেক্টিভ আনকনশাস টের পেলে বোঝা যাবে  কলকাতার ভিতরে কলিকাতারও উচ্চারণের নিজস্বতা আছে, আছে বাক্যের নিজস্ব বটতলা, আছে, আছে চটির উথাল, আছে মাকালী ও বড়ঠাকুরের থান , আছে পাগলাবাবার মাজারে কাওয়ালি বঙ্গের দিলখোলা হাওয়া… তাছাড়া হাওড়া, হুগলী, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, দুই ২৪ পরগণার উচ্চারণও আলাদা। যেভাবে চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়ময়সিংহ, বরিশাল, নোয়াখালি, পুরোনো ঢাকা-সহ গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের একেক জায়গার উচ্চারণ একেকরকম। কিন্তু সেইসকল উচ্চারণের ভিন্নতাকে এক ছাঁচে ফেলতে চায় বাংলা একাডেমি।

আসলে আমার মতে সাহিত্যের ভাষাকে প্রমিতকরণের মূল কারণ হল, সাহিত্যের ভাষাকে মাস মিডিয়ার ভাষা করে তোলার কর্পোরেট প্রয়াস। এবং আজকের বহুজাতিক কর্পোরেটের যে ভাষা-রাজনীতির যে প্রোজেক্ট, তা আসলে জমিদার বর্ণহিন্দুর বঙ্গীয় সমাজ-রাজনীতির সামন্তবাদী ও উপনিবেশিক আবহের উত্তরমুখ। এবং সেই উপনিবেশিক ও বর্ণবাদী রাজনীতির কেন্দ্র হল কলকাতা। তাই তার লিঙ্গুইস্টিক পোলিটিক্সও মূলত ঔপনিবেশিক এবং সেই সূত্রে আজ তা বহুজাতিক কর্পোরেটের ইশারায় নিয়ন্ত্রিত, যে ইশারা আসলে দিল্লির আসলে ম্যারিকার, আসলে শেয়ার বাজারের… আমি যতটা বুঝি, এর বিরুদ্ধে রাইসু ও আরও হাতে গোনা দুয়েকজন অনেকটাই লড়ছেন। কেউ জেনে বুঝে লড়াই চালাচ্ছেন অথবা কেউ অজ্ঞাতসারে। ব্রাত্য রাইসুর জন্মদিনে তাঁর এই লড়াইকে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু আবারও তাঁকে বলব, গোটা পশ্চিমবঙ্গকে ‘কলকাতা’র সঙ্গে মিলিয়ে দেখা উচিত নয়। যেভাবে পশ্চিমবঙ্গকে ইন্ডিয়া বলা উচিত নয়।

ব্রাত্য রাইসুর ভাষা-রাজনীতি নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে পড়লো, রাইসুকে ডেডিকেট করে বছরখানেক আগে একটি কবিতা লিখেছিলাম, সেটি এই লেখার শেষ পেশ করে, এই লেখায় ইতি টানছি। আসলে ইতি বলে কিছু হয় না। হয়তো পর্বান্তরে পরবর্তী সময়ে রাইসু ও তাঁর বাঙালী মুসলমান পরিচিতিসত্তা আর সামাজিক পরিসরে তাঁর অবস্থান ও অবস্থানের বদলে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে কিছু লিখবো। তবে শেষে এ কথা বলি, রাইসু নিরন্তর নিজেকে বদলে বদলে চলতে পছন্দ করেন, অথবা, তিনি আসলে তিনিই, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সমাজ বাস্তবতাকে নানাভাবে ঠোক্কর দিতে নিজের সম্পর্কে তিনি বেশ কিছু ধাঁধা তৈরি করেন, তৈরি করেন ধোঁয়াশা। যা আমাদের কখনো কখনো বিরক্ত লাগে, আবার কখনো মনে হয় ইহাই রাজনীতি। আবার এটাও মনে হয়, পুরোনো অবস্থান থেকে তিনি তখন বদলে যান, যখন তাঁর মনে হয় নতুনটাই নতুন প্রবাহের বার্তা। আবহমানের প্রবাহে অনেক অনেক নতুনে যাত্রা করুন ব্রাত্য রাইসু। পঞ্চাশ বছরে আপনাকে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন, চিয়ার্স।

এবার রাইসুকে লেখা আমার কবিতা:

ভাষা
(ব্রাত্য রাইসুকে)

ভাষার নৌকা গুরু ভাসায়েছো
কোন তীরে
একা একা আলেয়ায়
আলেয়ার গাছগুলি
দ্যাখো একা একা
তোমার মতই খুব
ফিসফিস মন্ত্রণা দিয়ে
ভাষার তাবিজ বানায়
ভাষার নৌকা গুরু ভাসায়েছো
রাঙা মেয়ে বর্তুলে
মাটির বেদনা ঘিরে
পাকাধান আমনবেলায়
তোমারে ডেকেছে বিকেল
একা একা ঝাউবনে
জন্ম জন্ম গুরু
দেয়ালায় দেয়ালায়
এই নৌকা জানে, মতস্যবাহার জানে
ডুবো জলে কবিরেই
একা একা ভেসে যেতে হয়
গুরু, লোকমুখে ভাষায় ভাষায়

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ,  ১৯ নভেম্বর ২০১৭

Leave a Reply