রাইসুনামার কিয়দংশ

আমাদের সাহিত্য ও ফেসবুক-সমাজে ক্রমশ রাইসু একটি কৌতূহল-জাগানো চরিত্র হয়ে উঠেছেন। তবে ফেসবুক-যুগের আগে ও পরে—এই দুই কালপর্বে রাইসুর আত্মপ্রচার এবং চিন্তা ও সত্তার প্রসারণ স্পষ্টত দুই জাতের। তাঁকে অপছন্দ করা চলে, উপেক্ষা বা অস্বীকার নয়। এই নষ্টভ্রষ্টভণ্ড ও কূপমণ্ডুক সমাজে নিঃসন্দেহে রাইসু এক ধরনের বিরল ব্যতিক্রমী ব্যক্তি হিসেবে অস্তিত্বমান। কখনো কখনো তাঁর সত্যোচ্চারণে কেঁপে ওঠে মানব-বামনের প্রতিষ্ঠিত ভাবমূর্তি-প্রাসাদ। কখনোবা তাঁকে পায়ে দলে যায় অর্থ-অনীতি। আর প্রায়শ তাঁকে সতর্ক সাগ্রহে এড়িয়ে চলে ‘সামাজিক’ শুদ্ধতা।

মারুফ রায়হান

হুমায়ূন তাঁর সৃষ্ট হিমু চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন রাইসুকে। কে জানে রাইসুকে দেখেই তিনি হিমুকে জন্ম দিয়েছিলেন কিনা। অবশ্য আমার কাছে রাইসু রাইসুই। রাইসুর এক কর্মস্থলে একবার চেহারায় তাঁকে আমার চিত্রকর অ্যালব্রেখট ডুরার বলে মনে হয়েছিল। সামনে ছিলেন সাজ্জাদ শরিফ। তিনি সায় দিয়েছিলেন আমার কথায়। যদিও এইসব মিলটিল ধর্তব্য নয়। রাইসু এক একক সৃজন। তিনি কারো মতো নন, তাঁকে কোনো গোত্রেও ফেলা যাবে না। এই স্বকীয়তা বা স্বাতন্ত্র্য দুর্লভ। একইসঙ্গে তিনি বিনোদন ও ব্যবচ্ছেদ, বিভা ও নেভা, ব্যক্তি ও ব্যক্তিগত-ঊর্ধ্ব।

রাইসু পঞ্চাশ উদযাপন করছেন কিছুটা স্মারকগ্রন্থ প্রকাশনা-আয়োজনের ফর্মে (প্রয়াত লেখকের ক্ষেত্রে অন্যেরা যেমন করেন আরকি); ঠিক এর আধা দশক আগে এই নভেম্বরেই আমিও ‘হাফ সেঞ্চুরি স্টোন’ ফেলে এসেছি স্বরচিত কুণ্ঠায়। সে যাক। বিচিত্র বিস্তর ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছি বলে দ্রুত কয়েকটি বাক্য লিখে উঠতে চাইছি, যাতে রাত বারোটা এক মিনিটের আগে নিশ্চিতভাবেই তাঁকে এটি পাঠনো যায়।

রাইসুর কবিতা ভাবে-ভাষায়-ভঙ্গিতে কিছু অভিনবত্ব উপহার দিয়েছে। পূর্ববর্তীরা লেখেন নি, দেখেন নি এমন কিছু উপাদান তাঁর ভাণ্ডারে। আমরা মৌলিক বলতে যা বুঝিয়ে থাকি কবিতাবিচারের বেলায়, এমন বিষয়আশয় রাইসুর কবিতায় রয়েছে। জাত কবিরা রাইসুর কবিসত্তাকে অভিনন্দিত না করে পারবেন না। যেমন, জয় (গোস্বামী) ঢাকায় আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন রাইসুর সঙ্গে যেন তাঁর যোগাযোগ করিয়ে দিই। তখনো পর্যন্ত রাইসুকে তিনি স্বচক্ষে দেখেন নি। রাইসুর বেশ কিছু কবিতার চরণ তখন তাঁর ঠোঁটস্থ।

অনলাইনকে বাংলা কবিতাঙ্গন করে তোলা ও অনলাইনে কবিতার প্রসারে পথিকৃতের মর্যাদা তাঁকে দিতে আমার কার্পণ্য নেই। দেড়-দু’দশক আগে ‘কবিসভা’ ফোরাম তিনি গড়েছিলেন অনলাইনে কবিতা ও কবিতা বিষয়ক আলোচনা শেয়ারের জন্যে। সেটি ছিল অনলাইনের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার। পরে আরো সক্রিয়তা বাড়িয়েছেন তিনি এই আকাশজমিনে। পথিকৃৎ অনেক সময় আর পথিক থাকেন না, এখানেও রাইসু ব্যতিক্রম।

এমন একটি কবিতা-গুমকারী কবিতাকরুণ কালে রাইসুর জীবনের বিশেষ একটি সময় এসে উপস্থিত হয়েছে যখন প্রকৃত কবিসত্তাকে বিবিধ ব্যাধির সংক্রমণমুক্ত রাখা এক জটিল চ্যালেঞ্জ। শুধু এটুকু বলতে চাই, রাইসুকে আমি ভালোবাসি। তাঁর কোনো উপকারে না আসতে পারলেও তিনি ভালো নেই এমন ইংগিত পেলে আমার ভেতরে তাঁর জন্যে এক ধরনের সহমর্মিতা জেগে উঠেছে সবসময়। যদিও ভাবনা আসে—এসব দীর্ঘশ্বাস কি যুগপৎ আমাদের নিয়তি ও অর্জন নয়? আমি রাইসুর সর্বাঙ্গীন কল্যাণ কামনা করি। আর চাই, যত দিন যত বছর ইচ্ছা তিনি যেন এই মৃতপ্রায় ঢাকা নগরীতে স্বরূপে জারী থাকেন। তাঁর যেন চরিত্রচ্যুতি না ঘটে।

রাইসু, শুভ জন্মদিন। ভালো থেকো।

১৮ নভেম্বর ২০১৭

Leave a Reply