রাইসুর প্রতি বিরাগ ও অনুরাগ

ব্রাত্য রাইসু আমারে তাঁর পঞ্চাশতম জন্মদিন উপলক্ষে কিছু লিখতে বলছে। বুঝলাম এটা কোনো বিশেষ অনুরোধ না। একটা গড়-দায়সারা একটা অনুরোধ।

তবে রাইসু এই রকমই।  এটা ধইর‍্যা নিলে আর তার কথায় সামাজিকতা বা সৌজন্য না খুইজ্যা না পাইলে  অবাক হইতে হইবে না। রাইসু কেবল নিজের ইচ্ছা আদায় করতে বা পাইতে খুবই আগ্রহী। কিন্তু অন্যে কেন তার খায়েশ পূরণে আগাইয়া আসবে, কেন আগাইয়া আসতে পারে সেইসব নিয়া রাইসু ভাবার পক্ষপাতি না।

রাইসু সমাজে থাকে, অবলীলায় সমাজের সামাজিকতার সুবিধা ও একটা সমাজ থাকার সুবিধা পুরাটাই সে নেয়। এত সুবিধা যে সমাজ রাইসুরে দেয় সেই সমাজ টিকানোরও কিছু দায় তাহলে তো রাইসুরে নিতে হয়। না সেইটা নিয়া ভাবার দায় রাইসু মাথায় আনে না।

এইটা রাইসুর বেলায় সেটা ঠিক স্বার্থপরতা নয়। যদিও তাই মনে হইতে পারে। রাইসু আসলে সামাজিকভাবে দলেবলে কিছু করতে আগ্রহী না। সেইজন্য ফাইনালি রাইসু কেবল পাইতে চাওয়া এক লোক হিসাবে আমাদের সামনে এপিয়ারড হয়।

পিনাকী ভট্টাচার্য

আমার সাথে রাইসুর দেখা হইছে একবার। আমার মনে হইছে খুব লাজুক একটা ছেলে। মনে হইছিল বয়সে আমার চাইতে ম্যালা ছোট। কিন্তু এখন বুঝি সে আমার সমবয়সীই বলা যায়। সম্প্রতি আমি যেই লেখালেখি করি, যেই লাইনে চলাফেরা করি, আমি আসলে এই জগতের মানুষ ছিলাম না। আমি ২৪ ঘণ্টা মাথা গুঁজে কাজ করা কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ ছিলাম। রাইসুরে আমার চেনার কথাও না।

আমি অল্পবিস্তর লেখালেখি করতে শুরু করি ২০১২-তে। রাইসুর লগে দেখা ২০১৩-তে শাহবাগের শেষ দিকে। রাইসু সম্পর্কে আমারে একজন খুব মেধাবী আর চৌকস প্রবাসী যুবক কইছিল, আমাদের সময় ‘রাইসুর সময়’ বলে পরিচয় পাবে; সে একজন কাল্ট লাইক ফিগার।

আমি রাইসুর এমন উচ্চ প্রশংসা শুইন্যা খুব অবাকই হইছিলাম। একবার একজন কোনো এক অনুষ্ঠানের আয়োজক একজন বিশেষ বক্তা খুঁজতেছিলেন, আমার মনে হইল রাইসুই রাইট পারসন হইতে পারে।

আমি কইলাম রাইসুরে নাও। সেই আয়োজক মুখ বাকাইয়া কইলো, দাদা, রাইসুরে নিলে যেই বিপদ সেইটা হইতেছে সে গোল পোস্ট পাইলেই গোল দেয়, সেটা কোন দলের গোলপোস্ট বা কোন দলে সে খেলতেছে তা আর তার খেয়াল থাকে না।

এই কথাটাই আমি আমার এক বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করছিলাম যে, আচ্ছা, রাইসু তাঁর পরস্পরবিরোধী এত কন্ট্রাডিকশন নিয়া থাকে কীভাবে? ওর তো মাথায় জট লাইগ্যা যাওয়ায় কথা।

তিনি আমারে কইলেন, রাইসু তার  নানান কন্ট্রাডিকটারি আইডিয়াগুলারে কম্পার্ট্মেন্টালাইজ কইর‍্যা রাখে। ট্রেনের কামরার মত। যাতে তাদের মধ্যে ঠোকাঠুকি না লাগে। কারণ কন্ট্রাডিকটারি আইডিয়াগুলারএক জায়গায় এক ঘরের মধ্যে রাখলে বা থাকা মানেই তারা ঠোকাঠুকি কইর‍্যা পরস্পর পরস্পরকে ‘নাল অ্যান্ড ভয়েড’ মানে কাটাকুটি কইর‍্যা নাই কইর‍্যা ফেলবে। তাই একেক আইডিয়া একেক কম্পার্ট্মেন্টে রাখে বলে তার নিজের কাছে একটার সাথে আরেকটার কনফ্লিক্ট হয় না।

যারা কন্ট্রাডিকটারি আইডিয়া হোল্ড করে তারা এভাবেই চলে। আমরা আইডিয়াগুলারে কো রিলেইট করি, তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব রিসলভ কইর‍্যা রেসালটান্টটা আকড়ায় ধরি। আর সে আইসলেইট কইর‍্যা রাখে। এই হল ফারাক!

রাইসু মেগালোম্যানিক। একেক সময় নিজেরে নিয়া এমন বিশাল ধারণা নিয়া থাকে, যা অন্যকে ক্ষুদ্র বা তুচ্ছ জ্ঞান করে ফেলে বলে তা রিয়েলিটির সাথে মেলে না। এইগুলা তার ওয়ান ওয়ে এক্সপেকটেশন।

রাইসু যেভাবে সামাজিকতার ধার ধারে না; এর পালটা হিসাবেই কী অন্যেরাও তার উপরে সুবিধা নিয়া নেয়?

রাইসুকে দাওয়াত কইর‍্যা নিয়া গিয়া অবলীলায় তারে না খাওয়াইয়া গলা ধাক্কা দিতেও তাদের বাধে না? ব্যাপারটা কি তাই?

আমি ঠিক শিওর না। তবে ঘটনাটার পর থিকা প্রশ্নটা আমারে তাড়া করে। রাইসুর আবার সেইটারে ফেইস করার স্টাইলটাও নতুন। সে কোনো অপমানবোধের দিকে যায় না, সেইটা অপচয় বা নেগেটিভ এই বিবেচনায়। অনেকের মনে হইতে পারে সে বোধহয় সেইটারে উপভোগ করে তাড়িয়ে তাড়িয়ে। না সেটা একেবারেই না। তবে রাইসু কোনো বিরোধে, নন-কনফ্রন্টেশনাল  (ফিজিক্যাল অর্থ বিচারে) অবস্থানে থাকে— এইটা আমার মনে হইছে।

রাইসু সবকিছুকে ভাঙতে পারে—প্রবল বিক্রমে, শক্তিতে। এটা কিন্তু এক বিরাট গুণ। যেমন চিন্তা করেন যারা এটা একেবারেই পারে না তাদেরই আমরা কনজারভেটিভ বলে ডাকি। আর ভাঙা তো আসলে এরপর গড়ার আগাম ধাপ, এই অর্থে এটা ইতিবাচক।

কিন্তু রাইসুর খারাপ গুণ হইলো সে গড়তে পারে না। সে গড়ার সৈনিক না। তাই অনেকে বলবেন হয়ত রাইসু কখনো ভাঙা বা গড়া কনোটারই সাথী হইতে পারবে না। কারণ তাদের চোখে ভাঙা বা গড়া দু’টাই পলিটিক্যাল কাজ।

রাইসু এপলিটিক্যাল, রাইসু অরাজনৈতিক। রাইসুর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এটাই। রাইসু তাই যেমন কারো বন্ধু হইতে পারে না,সেভাবেই রাইসুর সম্ভবত কোনো প্রবল শত্রুও নাই। রাইসু তাই আকর্ষণ করতে পারে, কিন্তু বাইধ্যা রাখতে পারে না, রাইসু চায়ও না সেটা।

রাইসু তার অলীক জগতের খুবই নিঃসঙ্গ বাসিন্দা। সেই অলীক জগতে এই মাটির পৃথিবীর কোনো কিছুই রাইসুর কাছে মূল্যবান নয়। তবুও রাইসুরা থাকলে আমাদের পৃথিবী বৈচিত্র্যের স্বাদ পায়। এমন ক্ষ্যাপাটে কিছু মানুষ আছে জন্যই তো এই পৃথিবী এত বর্ণময়। আবার যখন কারোই ভাইঙ্গা ফেলার মুরোদ দেখা যায় না, বেশি বেশি চিন্তা করে বলে তখন ঐ স্বল্প পরিসরে রাইসুর একটা ভূমিকা থাকতে পারে। আমি সেই ভূমিকায় রাইসুরে পাইলে সতর্কতার সাথে খুশী হইবো।

অলীক জগতের নিঃসঙ্গ রাইসুরে জন্মদিনের অভিনন্দন।

রাইসু একবার তার ওয়ালে লিখছিল, সে আমারে ভালোবাসে। আমিও রাইসুরে ভালবাসি। তার সমস্ত অপূর্ণতা, তার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগের পরেও আমি তারে কইতে চাই—আই লাভ ইউ ম্যান!

Leave a Reply