রাইসুর লগে যা যা হৈছে

রাইসুরে নিয়া লেখতে বসছি, রাইসুর ভাষায়ই লেখি। এই ভাষায় যে আমার লেখতে ইচ্ছা হয় না তা কিন্তু না। তবে আমি মনে করি লেখকের দায়িত্ব হৈল শুদ্ধ ভাষা শেখানো, তাই আমি প্রমিত বাংলার চর্চা করি।

সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি। আমি তখন বাড্ডায় থাকি, উত্তর বাড্ডায়। রাইসুরা থাকত পূর্ব বাড্ডায়, পোস্টঅফিস গলির দিকে কোথাও। আমি কখনো রাইসুদের বাড়িতে যাই নাই, রাইসুও আমাদের বাড়িতে যায় নাই।

রাইসুর সঙ্গে আমার দেখা হয় কামরুজ (এডভোকেট সাইদুর রহমান কামরুজ) ভাইয়ের বাসায়। কথিত আছে, মুক্তিযুদ্ধের পরে কামরুজ ভাই এক কাঁধে অস্ত্র আর অন্য কাঁধে বুলবুলি ভাবিকে তাদের বাড়ি থেকে তুলে আনেন। সত্তরের দশকে কামরুজ ভাইকে বাড্ডার লোকেরা সমীহ করত, আশির দশকে দেখেছি তাকে সবাই ভালোবাসে, এই ভালোবাসায় কোনো ভীতিজনিত কারণ ছিল না। বুলবুলি ভাবির ছোটো ভাই রব্বানী রাইসুর বন্ধু ছিল। ওরা আমার চেয়ে এক বা দুই ক্লাস নিচে পড়ত। প্রথম দিনই রাইসু আমারে ‘তুমি’ কৈরা বলে।

কাজী জহিরুল ইসলাম

আমি তখন কলেজে পড়ি, ওরা মেট্রিক পরীক্ষা দিবে বা এই রকম কিছু। বুলবুলি ভাবি সাথে সাথে রাইসুরে সতর্ক করে দিয়ে বলে, বাদল (আমার ডাক নাম) তোমার সিনিয়র না? ‘আপনে’ কৈরা কইবা। রাইসু তার সেই লোকভোলানো হাসি দিয়া কয়, ‘তুমি’ ঠিকই আছে।

আমি ছোটোবেলা থেকেই সব মেনে নেই, রাইসুর ‘তুমি’ও মেনে নিলাম। আমরা তখন বাড্ডায় একটি সাহিত্য সংগঠন করতাম, কবি জসীম উদদীন পরিষদ। রাইসুরে বলি, তুমি আমাদের সভায় আসো। রাইসু আসে। কিন্তু ওইসবে রাইসুর পোষায় না। রব্বানীর সাথে কিন্তু আমার কোনো বন্ধুত্ব হয় নাই, রাইসুর সাথে কিছুটা হৈছিল। বন্ধুত্ব হওয়ার পেছনে কিছু একটা কারণ তো আছেই, দুইজনই লেখালেখি করি এইটা একটা কারণ হৈতে পারে।

একদিন আমি আর রাইসু হাঁটতে হাঁটতে রামপুরা ব্রিজে যাই। তখন সন্ধ্যা। ব্রিজের রেলিঙয়ে অনেকক্ষণ বৈসা থাকি। আমি তখন একটা দীর্ঘ কবিতা (তখনও লেখা শেষ হয় নাই) লেখতেছিলাম। যেইটুকু লেখছি তা পৈড়া শোনাই। রাইসু বলে ভালো হয় নাই। তবে “খেলা করে বিশ্রামরত মস্তিস্কটা নিয়ে” এই লাইনটা খুব ভালো হৈছে।

আমি রাগ করি নাই। আমার লেখা কেউ ভালো বললে খুশি হৈতাম কিন্তু মন্দ বললে রাগ করতাম না। রাইসু আমারে বলে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ কী, এইটা আমারে শিখাও। আমি জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইনকে বিশ্লেষণ করে ওকে অক্ষরবৃত্তের পর্ববিন্যাস শিখাই। আমার মনে হৈল রাইসু ছন্দটা ঠিক ধরতে পারে নাই। নিজেরে ব্যর্থ শিক্ষক মনে হৈল।

এর কিছুদিন পরে একদিন রাইসু আমারে কয়, আবদুল মান্নান সৈয়দ অনেক বড় কবি। পরাবাস্তব কবিতা লেখছে। তাঁর সাথে দেখা করন লাগব। চলো তাঁর লগে দেখা করতে যাই।

আমি কই, তারে কই পামু?

রাইসু কয়, ঠিকানা আছে। গ্রীন রোডে থাকে।

আমরা গুলশান এক নম্বর গোল চক্কর থাইকা ছয় নম্বর বাসে চৈড়া ফার্মগেইট যাই। সম্ভবত বাস ভাড়া আমি দিছিলাম (আমার ভুলও হৈতে পারে)।

আমরা মান্নান ভাইয়ের গ্রীন রোডের বাসায় যাই। অনেকক্ষণ দরজার বেল বাজাই, কড়া নাড়ি। এক লোক বাইর হৈয়া আসে। যতদূর মনে পড়ে বুড়া লোক।

কাকে চাই?

আবদুল মান্নান সৈয়দকে চাই।

তিনি নাই।

নাই কেন?

বাইরে গেছে।

কই গেছে?

খাড়ান।

বুড়া লোক দরোজা বন্ধ কৈরা ভিতরে যায়। অনেকক্ষণ পরে আবার আসে। শিল্পতরু অফিসে গেছে, ঐখানে পাইবেন।

আমরা ঐখানে যাই। গ্রীন রোড থেকে ভূতের গলি বা কাঁঠালবাগান (কোনো কাঁঠালগাছ চোখে পড়ে নাই) দিয়া হাঁটতে হাঁটতে শিল্পতরু অফিসে যাই। গিয়া দেখি মান্নান ভাই নাই। আমরা আবার হাঁটতে হাঁটতে মান্নান ভাইয়ের বাসায় আসি। দরজা খোলে বুড়া লোক।

আমরা বুড়া লোকরে বলি, ওইখানে নাই।

তাইলে ঐন্যখানে গেছে।

কই গেছে?

কই গেছে জানি না।

কখন আসবে?

রাত দশটার পরে আসবে। দশটার পরে আইসেন।

আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসি। গ্রীন রোডে ঘোরাঘুরি করি। আমার মনে হৈছিল মান্নান ভাই ভেতরেই ছিলেন, দেখা করতে চান নাই। আমাদের খিদা লাগে। রেস্টুরেন্টে গিয়া পুরি সিঙ্গারা খাওয়া যায় কিন্তু আমাদের পকেটে যথেষ্ট পয়সা নাই।

আমি বলি, রাইসু চলো ফিরা যাই।

রাইসু কয়, না ফিরা যাওয়া যাবে না। মান্নান সৈয়দের সাথে দেখা করতেই হবে।

রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করি।

আমি বলি, আমার টায়ার্ড লাগতেছে।

রাইসু বলে, চলো আমার মামার (বা খালার, এখন ঠিক মনে পড়ছে না) বাসায় যাই, কাছেই। ওইখানে গেলে খাওয়াবে।

আমি বলি, না অচেনা বাসায় যামু না। তুমি থাকো, আমি গেলাম। (পরে জেনেছি ওইদিন আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে রাইসুর দেখা হয় নাই। নব্বুইয়ের দশকের শেষের দিকে একদিন সাপ্তাহিক পূর্ণিমা পত্রিকার অফিসে বৈসা মান্নান ভাইরে এই গল্প কৈছিলাম। খুব মজা পাইছিল। মান্নান ভাই কয়, তাই নাকি? রাইসু তো কোনোদিন এটা বলে নি?)

আমি রাইসুকে ছেড়ে চলে আসি।

আমি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়ি। টিউশনি করি। ছোট ছোট ভাইবোন আছে। তাদের ভবিষ্যৎ আমার ওপর। এলোমেলো জীবন আমারে দিয়া হবে না। আমি রাইসুরে ছাড়লাম।

অল্প কয়দিনের আড্ডায়/ঘোরাঘুরিতে বুঝলাম, রাইসু ভিন্ন মাল। ওর সাথে আমার পোষাবে না। সে বলে শিল্পের জন্য শিল্প। কবিতা দিয়ে মানুষের কোনো কল্যাণ হবে না। কবিতায় থাকবে শিল্প।

আমি বলি, কবিতা জীবনের জন্য। সবকিছুই মানুষের জন্য। মানুষের কামে না লাগলে সবই অর্থহীন।

আমরা দুই মেরুর মানুষ।

একদিন দেখি রাইসুর হাতে কিছু কাগজপত্র। বোধ হয় একটি পত্রিকা বেইর করার প্রস্তুতি। সেইসব কাগজে লেখার চেয়ে আঁকিবুঁকি বেশি। রাইসুর নিজের হাতে আঁকা। ছবিগুলি বিমূর্ত এবং অপ্রচলিত।

অনেক বছর পরে, ১৯৯৫ সালের ২১ জানুয়ারি আমি একটি কবিতা লেখি, “তুমি দক্ষিণে আমি উত্তরে”। কবিতাটা আমি রাইসুকে উৎসর্গ করি।  তোফায়েল পারভেজ বলে এক তরুণ ছিল বাড্ডায়। সে নিয়মিত কবি জসীম উদদীন পরিষদে আসত। সব বিষয়ে তার খুব উচ্ছ্বাস ছিল। সে যখন মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কোনো একটা চাল বুঝে ফেলল, সে কী উত্তেজনা তার। “তুমি দক্ষিণে আমি উত্তরে” কবিতাটি আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পুরুষ পৃথিবী’তে ছাপা হয়। তোফায়েল একদিন আমাকে বলে, “আমি রাইসুকে এই কবিতা দেখাইলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কাজী জহিরুল ইসলাম কি আপনার বন্ধু? রাইসু বললেন, জহির বিখ্যাত হওয়ার লাইগা আমারে বন্ধু কয়। সে আমার বন্ধু না।”

আমি এই কথা রাইসুকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করি নাই। কবিতাটি এইখানে দিতেছি:

তুমি দক্ষিণে আমি উত্তরে

তুমি আমি কত কাছাকাছি।

একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু আমাদের

তুমি শিল্পের উপকরণ খুঁজতে দক্ষিণে প্রসারিত করো যাত্রাপথ

আমি জীবনের সন্ধানে এগোই উত্তরে

পরস্পর এই বিপরীতমুখী যাত্রায় কে কতটা এগিয়ে

সে হিসেব সময়ের কাছে সমর্পিত

তোমার সামনে অবারিত সমুদ্র

শুভ্র ঢেউয়ের ভাঁজে খুঁজে ফেরো শিল্পের উপকরণ

আমি অরণ্য সঙ্কুল পর্বতে দাঁড়িয়ে

ফলবতী বৃক্ষের কাছে প্রার্থনা করি সোনালি জীবন

আমাদের মাঝখানে দুই যৌবন দূরত্ব।

অথচ এক সময় আমার পিঠ ছিল তোমার পিঠের ওপর।

আবার আমরা মিলিত হবো

তুমি সমুদ্র পেরুলেই

আমি অরণ্য পেরুলেই

উল্টো পৃথিবীতে আমরা মুখোমুখি দাঁড়াবো।

বাড্ডা, ঢাকা, ২১ জানুয়ারি ১৯৯৫

ইয়াহুতে রাইসু ‘কবিসভা’ নামে একটা গ্রুপ করেছিল। ২০০৪-০৫ সালের কথা। সেই গ্রুপে আমি নিয়মিত ‘উড়ালগদ্য’ লিখতাম। ‘উড়ালগদ্য’ ছোট ছোট ভ্রমণ রচনা। তখন আমি আইভরিকোস্টে কাজ করি। আমার মনে হয় নাই, আমারে বন্ধু পরিচয় দিতে রাইসুর কোনো সমস্যা আছে।

একদিন রাইসু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার কবিতা কই? (মানে তাকে যেইটা উৎসর্গ করছিলাম)। কবিসভা থেকে আমার লেখাগুলো নিয়ে ঢাকার অনেক দৈনিক/সাপ্তাহিক কাগজ ছাপত। প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ বিভাগে অনেকগুলো লেখা ছাপে। এভাবেই ছুটির দিনের সাথে আমার যোগাযোগ হয় এবং অনেক দিন লিখি ওই বিভাগে। ছুটির দিনে দেখত তখন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী। পরে ইকবাল আমার নিকেতনের ফ্লাট ভাড়া নেয়, পাঁচ বছর ছিল সেই ফ্লাটে। কবিসভা গ্রুপ থেকে নিয়ে আমার কিছু কবিতাও নানান জায়গায় ছেপেছিল অনেকে। এর মধ্যে ‘হাটুনাথ রায়’ নামের একটি কবিতা জনকণ্ঠের সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়। এইগুলি আমি জানতাম না, পরে কেউ কেউ স্ক্যান করে আমাকে পাঠাইছিল। একবার ফেব্রুয়ারি মাসে ছুটিতে ঢাকায় যাই। বইমেলায় যাই। দেখা হয় আহমাদ মাযহারের সাথে। এর আগে তাঁর সাথে আমার পরিচয় ছিল না। আমিই ‘উড়াল গদ্য’র লেখক কাজী জহিরুল ইসলাম, এইটা জানতে পেরে তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। রাইসুর ‘কবিসভা’ গ্রুপ আমারে বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

রাইসু যখন ‘দৈনিক বাংলাবাজার’ পত্রিকায় কাজ করত তখন আমার একটি গল্প ছাপে। গল্পের নাম ‘তিনি আসবেন’। গল্পটা আমি রাইসুকে দেই নাই। দিছিলাম নাসরীন জাহানকে। তখন বাংলাবাজারের অফিস ছিল গ্রীন রোডে। নাসরীন জাহান ছিলেন সাহিত্য সম্পাদক। রাইসু যখন লেখাটি ছাপে তখন ‘বাংলাবাজার’ তেজগাঁয়ে। রাইসু তখন সাহিত্য সম্পাদক। অথবা নির্মলেন্দু গুণ সাহিত্য সম্পাদক। রাইসু তাঁর সহকারী। অথবা দুইজনই যৌথভাবে সাহিত্য সম্পাদক। কে কোন পদে আছে, এইসব তখন আমি খুব কম বুঝতাম।

ছুটিতে ঢাকায় এলে রাইসুর সঙ্গে দেখা হয়। সম্ভবত ২০০৭ সাল হবে। রাইসু তখন কাজ করে ‘দৈনিক যায়যায়দিন’ পত্রিকায়। আমি একদিন দেখা করতে যাই তেজগাঁর অফিসে।  রাইসু আমাকে শফিক রেহমানের সাথে পরিচয় করায়া দিতে চাইল। যারা বিদেশে থাকে স্যার তাদের খুব পছন্দ করে। রাইসুর মুখে ‘স্যার’ কথাটা কেমন বেমানান লাগল। আমরা গেলাম শফিক রেহমানের ঘরে। তিনি তখন ছিলেন না। পরের দিন রাইসু তার দলবল নিয়া আমার বাসায় আসে। নিকেতনের বাসায়। শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরীও ছিলেন সেই দলে। আমার মদের বোতলগুলি ওরা উজাড় করে। অনেক লম্বা সময় ধৈরা আড্ডা হয়। আমার ধারণা রাইসু তখন মার্ক্সবাদ খুব মন দিয়া পড়তেছিল। ওর কথায় মার্ক্সবাদি অনেক বিষয় আসছিল।

লক্ষ করতেছিলাম রাইসুর মধ্যে গুরু গুরু একটা ভাব আসছে। সে সব তর্কের একটা কনক্লুশন দিতে চায়। যেন চূড়ান্ত জ্ঞান কেবল তারই দখলে। অন্যকে তুচ্ছ করার মৃদু প্রচেষ্টাও লক্ষ করেছি।

রাইসু আমার বই চাইল, আমি দিলাম। সে তাঁর একটা বই দিল আমারে। ‘আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি’।  আমি তার বইটা পড়ছি। ভালো এবং মন্দ দুইটাই লাগছে।  তার ভাষায় আমার আপত্তি নাই, কিন্তু অশ্লীল ইমেজের অশ্লীল প্রকাশ আমি নিতে পারি নাই।

রাইসুরে আমি পছন্দ করি। পছন্দ করি এজন্য যে সে সত্য অকপটে বলতে পারে। কী পামু আর কী হারামু এই ডর রাইসুর নাই। রাইসুর সাথে তাই মন খুইলা কথা বলা যায়। গালিও দেওয়া যায়।

এই বিষয়টা আমি সব সময় রাইসুর কাছ থিকা শেখার চেষ্টা করি। সম্প্রতি এক ফেইসবুক স্ট্যাটাসে রাইসু কৈছে, আমার ঘৃণা নাই। আমি কাউরে ঘৃণা করি না। এইটা আমারও কথা। আমি মনে করি রাইসুর সাথে আমার এইটা একটা গ্রেট মিল। এই মিলের কারণে রাইসু আমার আজীবনের বন্ধু হৈতে পারে।

৫০ পূর্তিতে রাইসুরে শুভেচ্ছা জানাই।

নিউ ইয়র্ক, ৬ নভেম্বর ২০১৭

Leave a Reply