কবি, বুুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, আর্টিস্ট ব্রাত্য রাইসু আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড, ফেসবুকে আমাদের বন্ধুত্বের বয়স ৪ কি ৫ বছর।
এই নভেম্বরের শুরুতে রাইসু এক স্ট্যাটাসে জানাইল যে নভেম্বরের ১৯ তারিখ তার বয়স ৫০ বছর পার হবে; মনে পড়ল, নভেম্বরের ১৬ তারিখ আমার বয়স ৫২ পার হবে। রাইসু তার স্ট্যাটাসে জানায় যে সে তার পঞ্চাশ পূর্তিতে ফেসবুকে একটা ইভেন্ট খুলতে চায় যাতে তার বন্ধু ও পরিচিত জনেরা তাকে নিয়া কিছু লেখা-জোখা করতে পারে।
স্ট্যাটাসটা দেইখা ঠোঁটের দুই কোনায় একটা বাঁকা হাসি খেইলা গেল, মনে হইল, হ, রাইসুর ৫০ পূর্তির এই ইভেন্টে লেখি। কিন্তু রুটি-রুজির কসরৎ আর পারিবারিক দৌড়ে লেখার ভাবনাটা আর দানা বাঁধতে পারতেছিল না, ক্রমে চিন্তাটা মাথা থিকা আউট হইয়া যাইতেছিল। অতঃপর ৯ নভেম্বর জনপ্রিয় লেখিকা ও রাইসুর ঘনিষ্ঠা নাদিয়া ইসলামের কাছ থিকা মেসেনজারে এরূপ বার্তা পাইলাম:
“হাই ফরিদ, ব্রাত্য রাইসুর ৫০ তম জন্মদিন আসছে নভেম্বরের ১৯ তারিখ। আপনি রাইসুকে নিয়ে একটা লেখা দিতে পারবেন কি? মানে রাইসুর সাথে আপনার কীভাবে পরিচয়, কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা মনে আছে কি না বা রাইসুকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন এইসব। লেখার শব্দসংখ্যা আনলিমিটেড। লেখা দিতে হবে ১৭ তারিখের ভিতর। লেখা দিলে তার নিচে/ উপরে আপনার নাম, পরিচয়, জন্মতারিখ উল্লেখ করবেন প্লিজ। দিলে আমাকে লেখা ইনবক্স করবেন, না দিলে এই ইনবক্সের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নাই। আমার নাম নাদিয়া ইসলাম বাই দ্যা ওয়ে, আমি রাইসুর বন্ধু। আমি রাইসুর পরিচিত/ বন্ধুদের সবার লেখা পাইল-আপ করছি, যেটা ওর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে যাবে। থ্যান্কস।”
ফরিদ আহম্মেদ
এই বার্তা পইড়া আমার ঠোঁটের কোনায় আবার এক পশলা হাসি খেইলা গেল, নাদিয়াকে আমি এই উত্তর দিলাম:
“হাই নাদিয়া, থ্যাংক ইউ ফর সেন্ডিং মি দিস মেসেজ। রাইসুর ৫০ উপলক্ষে রাইসুর বিজ্ঞাপনটা পড়ার সাথে সাথেই আমার কিছু একটা লেখার জন্য মনটা আঁকাবাকা হচ্ছিল, রুটি-রুজি আর পারিবারিক ব্যাস্ততায় বিষয়টা আবার দূরেও সরে যাচ্ছিল। আপনার এই বার্তায় বিষয়টায় আরও ইনসপায়ার্ড বোধ করতেছি। আপনার দেয়া দিন সীমানার মধ্যে কিছু একটা লেখার ব্রত নিলাম, বাকিটা এলাহি ভরসা।”
জবাবে নাদিয়া একটা “Thank YOU”-র GIF পাঠাইলে আমি তাতে লাইক দিলাম।
২. পরদিন রাইসুর কাছ থিকাও এ সংক্রান্ত একটা লেখার অনুরোধ ইনবক্সে পাইলাম। যেহেতু নাদিয়ার কাছে আমি এ সংক্রান্ত করার জানায়া দিছি তাই রাইসুর মেসেজের কোনো জবাব না দিয়া এই লেখাটা কেমনে পাকানো যায় সেই বিষয়ে মনোনিবেশ করলাম।
৩. রাইসুর প্রথম স্ট্যাটাসটা পইড়া যখন লেখার ব্যাপারে মনমনাইতে ছিলাম তখনও নিশ্চিত ছিলাম না ঠিক কী আমি লেখতে পারি। নাদিয়ার মেসেজটা দ্বিতীয় বার পাঠের সময় দেখলাম ওখানে ‘কী লেখা যায়’-এর একটা গাইডলাইন আছে। ভাবলাম, এই গাইডলাইন অনুসরণে যা পারি তাই লেখি, আর এই লিখতে বসলাম।
৪. রাইসুর সাথে আমার কীভাবে পরিচয়?
যদিও ব্রাত্য রাইসুর সাথে আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডশিপ ৪/৫ বছরের কিন্তু আমরা পরস্পরকে মুখ দেখাদেখি চিনি ৮০-র দশকের মাঝামাঝি কোনো এক সময় থিকা। ঢাকার দূতাবাসগুলার কালচারাল সেন্টার (যেমন, ইউসিস, রাশিয়ান কালচারাল সেন্টার, আঁলিয়াস ফ্রসেজ, গ্যাটে ইনস্টিটিউট, ইত্যাদি) ভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনীগুলাতেই সম্ভবত প্রথম দেখাদেখি শুরু। যদিও দেখাদেখি হইত হরহামেশাই কিন্তু আলাপ হয় নাই তত। তারপর কবে থিকা আমরা পরস্পরকে তুমি সম্বোধন করি তাও মনে করার মত কোনো বিশেষ উপলক্ষ নাই তাই তা মনেও নাই।
উননব্বই সালে আমার এমএসসি পরীক্ষা হইয়া গেলে আমি জাহাঙ্গীরনগরের হল নিবাস সাঙ্গ করিয়া ঢাকায় স্থায়ী অস্থায়ী নিবাস নিলে পর আমার প্রায় প্রতিদিনের চক্কর ছিল পাবলিক লাইব্রেরি, চারুকলা, টি এস সি, হাকিম চত্বর , শাহবাগ, পি জি, পরে আজিজ মার্কেট, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, আর্ট এক্সিবিশন, ইত্যাদি। রাইসুকেও ঐ কালে দেখছি ঐসব মেল চক্করে। ইতমধ্যে রাইসু প্রকাশিত কবি, ‘গাণ্ডিব’ কবিদলে সে ঘুইরা বেড়ায়, কাছাকাছি কিন্তু প্রায় দূরে, অন্য কোন ম্যালে, অন্য কোনো ভাবধারায়।
৫. আমার নিজ বিষয়ে কতক টিকা টিক
এই কালে আমার প্রায় এরূপ ভাবধারা ছিল যে, আমার আশপাশের সব কিছু খুুব শ্যালো, কারো ভিতর কোন ডেপ্থ খুঁইজা পাইতাম না, সবাইরে মনে হইত ফাতরা, সবকিছুরে মনে হইত ফাতরামি-ইতরামি, এমনকি নিজেকেও তাই, ফলত আমি যদিওবা আশেপাশে তাকাইতাম কিন্তু কিছুই প্রায় দেখতাম না, মানে আমি আমার পরিপার্শ্ব বিষয়ে ছিলাম একান্তই অনওয়াকিবহাল, ভদ্রলোকেরা যাকে বলে ইগনোরেন্ট ঠিক তাই! যদিও আমি এসব চক্করের অনেকেরেই নামে-ধামে চিনতাম কিন্তু কারও সাথেই চিন-পরিচয় হয় নাই আরও দূর অগ্রগামী।
৬. রাইসুর সাথে আমার উল্লেখযোগ্য ঘটনা?
৬.১. রাইসুকে তখন সবচেয়ে বেশি দেখতাম সাজ্জাদ শরিফের সাথে। রাইসু সম্বন্ধে যে আমি বিশেষভাবে কিছু ভাবতাম এমন না, কিন্তু সাজ্জাদের অ্যাট্যুটুডের কোনো একটা দিক আমার বিশেষভাবে বিরক্তিকর লাগত, সেটা হৈল তার বেহুদা ঔদ্ধত্ব, এমন না যে সাজ্জাদের সাথে আমার এ সংক্রান্ত কোনো বিশেষ ঘটনা আছে, সাজ্জাদ আর আমার পারস্পরিক সম্বোধন ছিল আপনি, তো, সাজ্জাদের বিষয়ে আমার মনোভাবকে বলা যায়—এ ভেরি সাবজেকটিভ চয়েজ। এনিওয়ে, রাইসু-সাজ্জাদ যেহেতু একসাথে চলে তাই তাদের উভয়কে দেখলেই আমার কপাল কুুচকানি আসত। এমনও হইয়া থাকতে পারে যে, আমরা মনে মনে পরস্পরকে ভেঙচাইছি অনেকবার, তবে এখন এ বিষয়ে নিশ্চিত কইরা কিছুই মনে পড়তাছে না।
৬.২. পিজির নিচে বা পাবলিক লাইব্রেরিতে বা আজিজ মার্কেটে এ রকম অনেকবারই হইছে, দেখা গেল তিন-চাইরজন বা পাঁচ-ছয়জন বা সাত-আটজন বা আরও বহুজনের দাঁড়ানো আড্ডায় আমিও আছি আর রাইসুও আছে কিন্তু আজকে এইসব আড্ডার কিছু স্মৃতি শ্রুতি করতে গিয়া দেখি থিংকস আর অবলিভিয়াস।
এই সময় রাইসু কখনও কখনও বেগম আখতারের ঠুমরির কলি গাইত খেয়ালে-বেখেয়ালে, পাবলিকলি, আর বন্ধুদের, বিশেষত কিশোরীদের সাথে সাক্ষাৎ অভিভাষণ হিসাবে বলত—হোলা!
৬.৩. তারপর অনেক অনেক কাল আমাদের দেখা নাই, ২০০৫ থিকা আমি দেশছাড়া, তারপর ২০১১ কি ২০১২ তে আমি দেশে গেছি, তখন ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমিতে বইমেলা চলতাছে আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলতাছে গণজাগরণ মঞ্চ, সেই সময়কার কোনো এক বিকাল বেলায় আমি ছবির হাটের কাছে উদ্যানে খাড়ায়া আছি, দেখি কাজল শাহনেওয়াজ, সুমন রহমান আর ব্রাত্য রাইসু এক সাথে বইমেলা থিকা ফিরতাছে, আমারে দূর থিকা দেইখা তিন জনই সখা ভাবে আগায় আসে উষ্ণ অভিবাদনে আর আমিও পুলকিত হয়ে হই বিগলিত চিত্ত। সেটাই রাইসুর সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ।
৭. রাইসুকে আমি কীভাবে মূল্যায়ন করি?
রাইসুর সাথে ফেসবুক ফ্রেন্ডশিপের আগে রাইসুর লেখালেখি নিয়া আমার কোনো ধারণা ছিল না, তার সাথে আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডশিপের পর দেখলাম রাইসু কুতর্কের দোকান চালায়, তার কবিতার পোস্টের অধিকাংশতে আমি লাইক দেই, তার অ্যাক্টিভ বুদ্ধিজীবিতায় অ্যাকশন আছে, বুদ্ধিজীবী হিসাবে সে মাঠ গরম কইরা তোলার বুদ্ধিবৃত্তি প্রদর্শন সক্ষম।
ব্রাত্য রাইসুর বুদ্ধিবৃত্তির উদাহরণ স্বরূপ তার ঢাকা ক্লাব কাণ্ডের উল্লেখ করা যায়, যে বুদ্ধিবৃত্তিক নৈপুণ্যে সে ঢাকা ক্লাব কাণ্ডের উপস্থাপন ঘটাইছে, যে টান টান সার্কাস্টিক আমেজ শুরু থিকা সমাপ্তি অবধি তাল লয় সহকারে খেলা করাইছে তাতে আমি বিগ অপেরা দেখার আনন্দ উপভোগ করছি, অবশ্য এ রকমও কয়েকবার মনে হইছে যে মাজুল প্রতিপক্ষের নিষ্ক্রিয় অন্তর্ধানে অপেরাটা বিগ শো-য়ের কতক স্ট্রিং মিস করছে।
৮. ব্রাত্য রাইসুর ৫০ উত্তর আভিযাত্রায় শুভকামনা।