১৯৯৪ সালের গোড়ার দিকে একটা জিনিস আমি মনে মনে বুঝে নিয়েছিলাম: সাহিত্য করতে হলে সাহিত্যসমাজের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে সেই তরুণদের সঙ্গে, যারা নতুন ধরনের সাহিত্য তৈরির চেষ্টা করছে। আমার জন্যে সেটা খুব কঠিন ছিল।
আমি তখন চারুকলা ইনস্টিটিউটে (এখন যেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) ভর্তি হয়েছি। থাকি জগন্নাথ হলে। বৃহত্তর সাহিত্য সমাজের সঙ্গে আমার কোনো যোগ নেই। সেই যোগসূত্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে একদিন সন্ধ্যারাতে আমি যখন উপযাচিত হয়ে এগিয়ে গেলাম শাহবাগের আজিজ মার্কেটে সন্দেশের বইয়ের দোকানের সামনে ফুটপাতে আড্ডারত কয়েকজন তরুণের দিকে, তখন ওই তরুণদের একজন ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে।
শিবব্রত বর্মন
রাইসুর তখন কাঁধ পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুল। ফুলহাতা শার্টের হাতা এলোমেলো গোটানো। এই ব্যাপারটা আমার বিশেষভাবে চোখে পড়েছিল। শার্টের হাতা ওইভাবে কাউকে কখনও গোটাতে দেখিনি আমি। পায়ে স্পঞ্জের চপ্পল। প্যান্টের নিচটা গোটানো। এই বেশভূশার সঙ্গে একেবারেই বেমানান ছিল তার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতপ্রীতি। থেকে থেকেই সে কুমার গন্ধর্বের কোনো একটা কলি উচ্চৈস্বরে গেয়ে উঠতো। মাঝে মাঝে তার কণ্ঠে ধ্বনিত হতো ওই সময়ের জনপ্রিয় হিন্দি গানের কলি “লোয়ে লোয়ে আজা আজা মারি।” আমার চোখে এরকম একজন তরুণ ছিল টোটালি আনপ্রেডিকটেবল। ওইদিন একগাদা বই হাতে দাঁড়ানো আমাকে উদ্দেশ করে রাইসু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনে কী পড়েন?’
আজিজ মার্কেট রেগুলারদের মধ্যে রাইসুর সঙ্গে দ্রুতই আমার বন্ধুত্ব তৈরি হয়। এটা একটু অসম বন্ধুত্বই ছিল বটে। কেননা, শাহবাগে ওইসময় তরুণদের মধ্যে লিটল ম্যাগাজিনকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার যে স্পন্দন ছিল, তার কোনোকিছু তখনও আমার মধ্যে তৈরি হয় নি। আমার সাহিত্যরুচি তখন দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্রশাসিত। রাইসু আমার ঠিক বিপরীত। সে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী। আমি বলব, ওইসময় ওই বর্গের মধ্যে রাইসুই ছিল সর্বান্তকরণে প্রতিষ্ঠানবিরোধী। আমার পরিচিতজনদের মধ্যে সে-ই একমাত্র ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করতে গিয়ে যে কোনো সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান তৈরির চেষ্টা করে নি। আর বিশেষ করে মানুষে মানুষে দৈনন্দিন সম্পর্ক তৈরিতে ক্ষমতাকাঠামোর যে ছায়া পড়ে, তা পরিহারে সে বিশেষভাবে যত্নবান ছিল। এর একটা বহিঃপ্রকাশ ঘটতো বয়স নির্বিশেষে এক প্রজন্মের সবাইকে ‘আপনি’ সম্বোধন করার মধ্যে। বয়সে আমি তার চেয়ে বছর পাঁচেক ছোট হলেও সে আমাকে আপনি করে বলে।
রাইসুর সঙ্গে টই টই করে রিকশায় ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ানো আমার নিয়মিত রুটিন হয়ে দাঁড়ালো। মাঝে মাঝে আমি সকালবেলা বাসে করে রাইসুর মধ্যবাড্ডার বাসায় চলে যাই। সেখানে তার নতুন কেনা ঢাউস সাইজের গান শোনার যন্ত্রে আমরা খানিকক্ষণ মল্লিকার্জুন মনসুর বা ওঙ্কারনাথ শুনে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি গুলশানের দিকে। তখন ঢাকা শহরে ভিআইপি রোড বলে কিছুই ছিল না। আমরা রিকশায় করে যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো জায়গায় যেতে পারতাম। মাঝে মাঝে রাইসু আমার জগন্নাথ হলের রুমে এসে হাজির হতো। দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা ছেড়ে আমি তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম। আবার কখনও কখনও সে চারুকলায় গিয়ে আমাকে ক্লাসরুম থেকে বের করে আনতো। কত কত লোকজনের বাসায় যে রাইসু যেত। শান্তিনগরে মঈন চৌধুরীর বাসা, রাজারবাগে তীব্র আলীদের বাসা, বাংলা মোটরে আহমদ ছফার বাসা ইত্যাদি। মনে পড়ে রাইসুর সঙ্গে একবার হুমায়ুন আহমেদের এলিফেন্ট রোডের বাসাতেও গিয়েছিলাম। কেন যাওয়া হয়েছিল, এখন আর মনে পড়ছে না।
ওই সময় আমাদের যাওয়ার আরেকটা জায়গা ছিল গ্যাটে ইনস্টিটিউট। ফিল্ম সোসাইটিগুলি তখন দারুণ সক্রিয় ছিল। তারা নিয়মিত ছবি দেখাতো। ফেলিনি, ত্রুফো, গদারের ছবি দেখে গ্যাটে ইনস্টিটিটিউটের ছাদে চা-সিঙ্গারা খেতে খেতে অভ্যাগতরা ইউরোপীয় চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ঘরানা ও প্রবণতা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতেন। সেই পরিবেশে রাইসুর উপস্থিতির সঙ্গে আমি মিল খুঁজে পেতাম দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে উপন্যাসের লর্ড হেনরি চরিত্রটির। লর্ড হেনরি লন্ডন শহরের ভিক্টোরিয়ান কালচারকে কটাক্ষ করতেন। রাইসু তার সময়কার কালচারের নির্মম ক্রিটিক করতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই কটাক্ষের লক্ষ্যবস্তু হতো যাবতীয় প্রতিষ্ঠানবিরোধী এবং তাদের সাহিত্যতত্ত্ব। সে সময় দেরিদা আর ডিকনস্ট্রাকশন শব্দগুলো আজিজ মার্কেটের করিডোরে খুব ধ্বনিত হতো।
আমার সঙ্গে রাইসুর যখন পরিচয়, তখন রাইসু মঈন চৌধুরী সম্পাদিত লিটল ম্যাগ প্রান্ত-এর দ্বিতীয় সংখ্যা বের করার জন্য উপকরণ সংগ্রহ করছে। আমাকে সে হাইডেগার অনুবাদ করতে দিলো। আর বললো, গল্প দেন। প্রান্ত ম্যাগাজিনে আমার গল্প ছাপা হয়েছিল। তাতে লিটল ম্যাগাজিনের ওই সময়কার ভাষাভঙ্গির অনেক ছাপ ছিল, বুঝতে পারি।
পরিচয়ের মাসখানেকের মধ্যে আমাকে একবার গ্রামের বাড়ি যেতে হয়েছিল। ট্রেনে যাবো। রাইসুকে বলামাত্র সে বললো সেও যেতে চায়। আমি বাড়িতে চিঠি লিখে দিলাম যে, এবার আমার সঙ্গে ঢাকার একজন কবিবন্ধু থাকবেন। কাজেই বাসাটা যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সাফসুতরো দেখায় এবং আমার বন্ধুর অপরিপাটি বেশভূশায় তারা যেন অবাক না হন।
রাইসু আমার সঙ্গে আমার সৈয়দপুরের বাসায় গিয়েছিল। সেবার আমরা নানান জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি। ডোমার উপজেলায় আমার নানাবাড়িতেও গিয়েছিলাম। তাছাড়া গিয়েছিলাম রংপুর, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও। ঠাকুরগাঁওয়ে সিংরা ফরেস্ট নামে একটি শালবন আছে। সেই বন রাইসুর ভালো লেগে গেল। আমরা কান্তজীর মন্দিরও দেখতে গিয়েছিলাম।
মনে পড়ে রাতের বেলা খাওয়াদাওয়ার পর আমার বাবা রাইসুকে হারমোনিয়াম সহযোগে অনেকগুলো রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শুনিয়েছিল। রাইসুও দুয়েকটা গাওয়ার চেষ্টা করেছিল। এখনও বাবা ঢাকায় এলে জিজ্ঞেস করেন, ব্রাত্য রাইসু কেমন আছে? ও কি ওরকমই আছে? আমি বলি, ওরকমই আছে। বলতে গিয়ে আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, ২৩-২৪ বছর ধরে একটা লোক সম্পর্কে কত অনায়াসে আমি শব্দটা প্রয়োগ করতে পারছি।
ইত্যবসরে রাইসুর জীবনাচরণে পরিবর্তন খুব অল্পই এসেছে। তফাতের মধ্যে তার চারপাশের ঢাকা শহরটা বদলে গেছে। বদলে গেছে সামাজিক মেলামেশার ধরন। এখন মেলামেশাটা ভার্চুয়াল জগতেই বেশি হয়। রাইসু এই জগতের অতিসক্রিয়দের একজন। তাতে একটা দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন এই হয়েছে যে, রাইসুর পরিচিতি ঢাকার বাইরে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আর দ্বিতীয়ত এই ভার্চুয়াল জগতে রাইসুর উপস্থিতি একটি লিখিত বা টেক্সুয়াল উপস্থিতি। রাইসু তখনই অস্তিত্বশীল যখন সে কোথাও কোনো দেয়ালে কিছু লিখছে। এই প্রকারে রাইসু একটি সাব-কালচারের জন্ম দিয়ে ফেলেছে। অনেকে মনে করেন, এই সাব-কালচার মূলত রাইসুর ভাষাভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। আমি বলবো, ব্যাপারটা শুধুই ভাষাভঙ্গির নয়। রাইসুর বক্তব্যের কনটেন্টই এই সাব-কালচারের মূল চালিকাশক্তি। এই কনটেন্টের একটি স্পর্শযোগ্য বস্তুগত রূপ দেখতে পাওয়া যায় কুতর্কের দোকানের মধ্যে। আমি মনে করি, কুইন্টিসেনশাল রাইসুকে খুঁজে পাওয়া যাবে কুতর্কের দোকানের পোস্টগুলোর মধ্যে। এগুলো বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রত্নভাণ্ডার।
মোহম্মদপুর, ১৮ নভেম্বর, ২০১৭
1 Comment
Add Yours →অসম্ভব ভা্ল লাগলো।