ব্রাত্য রাইসুকে আমি চিনতাম না আগে। আসলে বিপণনকৃতদের বাইরে কোনো কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদককেই চিনতাম না। রাইসুও যে বিশ্ববিদ্যালয়-পাশ হাবাগোবাদের বিশেষ চিনতে আগ্রহী ছিল তাও মনে হয় না। বিশেষ করে তথাকথিত ভাল রেজাল্টওয়ালাদের। তথাপি ১৯৯২ সালে রাইসু ও আমি বিরল এক উপায়ে সহকর্মী ছিলাম অল্প কিছুদিন, এবং খুব জটিল উপায়ে। এই যে এই ঘটনাটি রাইসুর সম্ভবত মনেই নাই, আর আমি যে যাকে বলে ‘হৃদয়ের মণিকোঠায় যতন করে রেখেছি’ এটাই রাইসুর মত চৌম্বক-ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমার মত বস্তুরাজিসম মানুষদের পার্থক্য।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তখন ‘এই সময়’ নামের একটি সাপ্তাহিক সম্পাদনা করেন। আমি সেখানে পাশ করার পর নিতান্ত ফুটোকড়িহীন অবস্থাতেও বিনি-বেতনে যোগ দিই। অধ্যাপক চৌধুরীর পত্রিকার তখন বা এখন এমনই শান, বেতন ছাড়াও লোকের জান-কুরবান। আমি রাজনৈতিক থেকে ক্রিকেটিয় কলাম লেখক হবার বাসনাকাতর। আর ‘এই সময়’ তখন সকলকে বেতন দিতে অপারগ। আমরা উভয়পক্ষ খুশিমনেই যুক্ত।
মানস চৌধুরী
যাহোক, কোনো এক সন্ধ্যায় এলিফেন্ট রোডের অফিসের সামনের শানবাঁধানো জায়গায় সিগ্রেট খেতে খেতে আবিষ্কার করলাম এই মুহূর্তে সুদর্শন যে যুবকটি সকলের সঙ্গে সারামুখ হাসিময় কথা বলছেন তিনি কেবল বেতনভুকই নন, বরং প্রায় সকলের আগ্রহভাজন, মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। কথা বলছেন বললাম বটে, তিনি মুখ্যত কথা ছিটাচ্ছিলেন, আর আমাদের থেকে মুরুব্বিরা, সিগ্রেট খেতে খেতেই, সেসব ছিটানো কথা থেকে টুকরো টুকরো কথা কুড়িয়ে নিচ্ছেন। সীবীচে যেভাবে কিছু ঝিনুক আকর্ষণীয় বিবেচনা করে লোকজন কুড়িয়ে থাকেন আর কি! এই সুদর্শন যুবকটি ছিলেন ব্রাত্য রাইসু। এখনও আছেন।
আমার প্রায় নিশ্চিত মনে পড়ে ওই আড্ডায় একমাত্র সিগ্রেটহীন লোকটি ছিল রাইসু। আর একমাত্র গৌণ মিঁউ মিঁউ লোকটি ছিলাম আমি। তা যদি কিছু সন্দেহ থেকে থাকে, অন্তত রাইসুর মনোজগতে সবচেয়ে কম গুরুত্বের লোকটি ছিলাম আমি। বিশ্বাস না হয় আপনারা ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। ও মনেই করতে পারবে না।
‘এই সময়’ আমার জন্য দীর্ঘ সময় বয়ে আনে নি, স্বল্প সময়েই শেষ হয়ে যায়। টাকাপয়সার টানাটানিতে কলামলেখক হবার স্বপ্ন দুরূহ কেবল তাই নয়, আরও কারণ ছিল। তার মধ্যে পত্রিকার সেকেলে সম্পাদকীয় অনুশীলন একটা অন্যতম কারণ। কলম দিয়ে কেটে-কেটে লেখার মেরামতি, আমার লেখা হোক বা আর কারো, হজম করার মতো মাথা আমার ছিল না, তা আমি কাগজে কলমে যতই সিস্টেমের ভাল রেজাল্টধারী হই না কেন। যা হোক পরিশেষে অধ্যাপক চৌধুরীর অমিত ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যলাভ আর দারিদ্র্যের মধ্যে শেষোক্তটি বিজয়ী হলে আমি আর ওই পত্রিকায় যাই না, লিখি না। কিন্তু অনেকদিন আমার এই কৌতূহল যায় নি যে কীভাবে এত সনাতনী পদ্ধতির (কনটেন্ট নয়, কার্যরীতি) একটা পত্রিকা ও তাঁর সম্পাদক রাইসুকে এত মুখ্য গুরুত্ব দিয়ে সেবন করে থাকেন।
পরের বছরগুলোতে নিজের প্রচেষ্টায় আমি আবিষ্কার করেছিলাম প্রকাশনা ও তদীয় ব্যবস্থাপনায় রাইসু প্রায় রত্ন একটা। ওর রচয়িতাগুণ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যকে স্বতন্ত্র রেখেই বলছি। অল্প সময়েই আমি ঢাকার কথিত ছোটকাগজ ও তার উৎপাদন সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ জ্ঞানগম্যি লাভও করেছিলাম বটে।
আমার কিছু স্বভাবের/অভ্যাসের (এই দুয়ের সম্পর্ক নিয়ে আপনাদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ লাগতে পারে) কারণে রাইসুকে আমার অনায়াসে অপছন্দ করতে পারার কথা ছিল। ঈর্ষার কথা বলছি না, বরং বলছি বিদ্বেষ বা ঘৃণা, হুম অপছন্দই নম্রার্থে। কিন্তু আমার মনে পড়ে অত অনায়াসে আমি তা করতে পারি নাই। বরং, লোকটাকে নিয়ে আমার কৌতূহল জাগরুক হয়েছিল। এত বছর পর মনে হয় সেটার কারণ আমি অনায়াসে বলতে পারি। চলতি ভাষায় সহজ করে বললে একে বলে বাকস্ফূর্তি। কিন্তু আমি আরেকটু ঘন করে বলব যে ওর বলার সাবলীলতার পাশাপাশি অনায়াসে প্রচলিত ক্যাটেগরি ও প্রিমাইজ (বর্গ ও অনুকল্প) ভাংচুর হতে থাকে। সেটা আমাকে কৌতূহলী ও আকর্ষিত করেছে যুগপৎ।
নিজের রুটিরুজি, ঢাকা শহরে টিঁকে থাকার দুর্নিবার সংগ্রাম, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কামারা বেয়াদব সাব্যস্ত হবার হকিকত নিয়ে পরের বছরগুলোতে লোকটাকে আর দেখা হয় নাই। আরও একটা গুরুতর কারণ আছে। কোনো না কোনো কারণে সাহিত্য-শিল্প-ললিত-কারু-বৌদ্ধিক ইত্যাকার চক্রসমূহে আমার কখনোই আরাম না-লাগা। উত্তরকালে আমি আবিষ্কার করেছি রাইসুও বিশেষ আরাম পায় না। অন্তত তাই মনে হয়েছে আমার। তবে পার্থক্য হলো ও ‘দাবিনামা’সমেত সে সবে থাকে, বা বিরাজ করে। আমি সশরীর হাজির হতেই অনীহ। আমাদের দেখা হয় নাই। হতোও যদি রাইসু আমাকে বিশেষ মনে রাখত বলে আমি ভরসা পাই না। যাক গে!
১৯৯৭/৯৮/৯৯ বা ২০০০/২০০১ এর কোনো এক বইমেলায় রাইসুর পিছনে আমি ছিলাম ভিড়ে। ও আমাকে দেখে নাই, বা দেখলেও ওর কিছু আসে যায় না ধরনের আমি তখন। দুই সদ্যস্নাতক সাংবাদিক ওর পিছু নিয়ে মাইক্রোফোন হাতে ওর একটা সাক্ষাৎকার নিতে চেষ্টা করছেন। মিনি-সাক্ষাৎকার। বুঝলাম ইন্টারনেট তিনি কেন ব্যবহার করেন, নেটের কী উপকারিতা এ রকম জিজ্ঞাসাকে সামনে রেখে। বলাই বাহুল্য, ইন্টারনেট তখনো দুর্লভ এবং রাইসু বরাবর প্রথম জমানার প্রকৌশল ব্যবহারকারী, নেটেরও। অম্লান বদনে রাইসু যখন একগাল হেসে, চুল নাড়িয়ে বলল “নেটে আমি পর্ন দেখি” তখন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে এই বচন হজম করা দুরূহ লাগল। আমার যদি লেগে থাকে, ওই সাংবাদিক যুগলের এতটুকু কম লাগে নি আমি নিশ্চিত। ওরা প্রশ্ন পুনরায় বললেন। এটাই একমাত্র কারণ কিনা জানতে চাইলেন। রাইসু হাসিসমেত এবং ছাড়া দৃঢ়তার সঙ্গে জানান দিলেন এটাই কারণ। এই লোককে আপনি উপেক্ষা করতে পারবেন না।
রাইসুর সঙ্গে একটা কার্যকরী পেশাদার যোগাযোগ হয় আমার ২০০১-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান হামলার কালে। বইমেলার ঘটনা তার তাহলে আগেই হয়েছে। আমি ইমেইল ব্যবহার করি তখন, এবং বিস্ময়করভাবে একটা ল্যান্ডলাইন ফোনও আমার আছে তখন, আমার একমাত্র সম্পত্তি ওই সময়ে। রাইসু আমার একটা অনুবাদ প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় ছেপেছিলেন। তালিবানপন্থী বলে কথিত ওই রচনা প্রকাশনার কারণে আমার তো বটেই, আমার ধারণা রাইসুরও ব্যাপক হুজ্জত পোহাতে হয়েছে। রাইসু কখনোই ওর হুজ্জত আমাকে বলতে যায় নাই। সম্পাদক রাইসু বরাবরই তাই ছাপেন যা তাঁর জরুরি মনে হয়। এই সরল সাহস (আর কোনো শব্দের অভাবে বললাম, হয়তো এটা অন্য একটা পরিস্থিতিতে সাধারণ পেশাদারিত্ব হতে পারত) রাইসুকে ক্রমাগত আকর্ষণীয় করেছে আমার কাছে।
ব্রাত্য রাইসুকে নিয়ে কয়েক হাজার শব্দ লিখতে পারলে আরাম পেতাম আমি। কিন্তু মুস্কিল হলো কোনো কিছুই আমার লেখা হয়ে ওঠে না। কোনো একদিন হাজার হাজার শব্দ লিখে ফেলা হবে এই ভরসায় আজকের এটুকু না লেখার মূর্খতা করতে আমি রাজি নই। আমি সেদিন একটা ফেসবুক কমেন্টে লিখেছিলাম: “রাইসু আমাদের সমকালীন সাহিত্য-শিল্প আত্মার প্রায় একমাত্র নির্মোহ আয়না। ও সামনে থাকলে আমরা যে যা তা বুঝে ফেলি।” কথাটা একটা পরিস্থিতিতে বলা। কিন্তু কথাটা পুনর্বার বলতে আমি পারি। সমকালীন শিল্প-সাহিত্যে এমন নন-প্রিজুডিসড, এমন শব্দখেলুড়ে, এমন মুডভাঙানি, ক্যাটেগরি ও প্রিমাইজের এমন বারোটা-বাজানোদার থাকায় আমি আনন্দ বোধ করি কেবল তাই নয়, আমি ভরসা বোধ করি। মৈত্রী বোধহয় একে বলা যায়।
আদাবর, ১০ নভেম্বর ২০১৭